হাসান জাহিদ
Advertisement
সুন্দরবন, রূপে অপরূপা। জাদুবাস্তবতাময় ম্যানেগ্রোভ বন সুন্দরবন আর ইউনেস্কো হেরিটেজ সুন্দরবন। সুন্দরবনের দুই অংশ-ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের দক্ষিণের অংশ। দুই অংশেই একটি বিষয়ে অপূর্ব সহাবস্থান। সেটি হলো বনবিবি। বনবিবি-বিশ্বাস ও পাঁচালিগানে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান লক্ষণীয়।
তবে ভৌগোলিক বিভাজনের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন পশ্চিমবঙ্গের বন থেকে বহুবছর পেছিয়ে গেছে।প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বাঘ সংরক্ষণে অনেক এগিয়ে আছে ভারত। এমনকি ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল বাঘ ও বন্য জীবজন্তু সংরক্ষণে রীতিমতো সেনাবাহিনী বসিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের বনের অংশে বনদস্যু ও সীমাহীন সম্পদ আহরণে বন সাফ হয়ে যাচ্ছে। বাঘেরা বাসস্থান হারিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঢুকে মানুষের পিটুনিতে বেঘোরে প্রাণ হারায় আর ‘মানুষখেকো’ আখ্যা লাভ করে।
২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সাল নাগাদ বাঘ দ্বিগুণ করার ঘোষণা ছিল। সেই ঘোষণার প্রেক্ষিতে ভারত যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে বাঘের সংখ্যা বাড়ায়। আর বাংলাদেশর বাঘ বিপন্ন হয়ে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মনুষ্য হস্তক্ষেপজনিত কারণে।
Advertisement
‘জাঙ্গল নামা: আ স্টোরি অব দ্য সুন্দরবন’ গ্রন্থটি লিখে ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক অভিতাভ ঘোষ বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন বাংলার বনবিবির কাহিনি। সুন্দরবনের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি বার বার জেগে উঠেছে অমিতাভ ঘোষের কলমে। তার রচিত ‘দ্য হাংরি টাইড’-এও নজর কেড়েছিল বনবিবির প্রতি লেখকের মুগ্ধতা। বনবিবির পালারই একটি পর্ব অবলম্বনে নতুন পদ্যের বই লিখেছেন জ্ঞানপীঠ বিজেতা। যাত্রা, পালাগানের দাক্ষিণ্যে কাহিনি আমাদের চেনা। বনবিবি নিয়ে হরেক রকমের সাংস্কৃতিক মোজেইক তৈরি হয়েছে। পালা-পার্বণ-পুজো, পুঁথিপাঠ, বনবিবি উৎসব প্রভৃতি।
হারিয়ে যেতে বসেছে সাতক্ষীরার বনবিবি বটতলা প্রায় ৩.৫ একর জমির ওপর বিস্তৃত এই বটতলা। সাতক্ষীরা শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার গেলে দেবহাটা উপজেলা সদর। সেখানে রয়েছে হৃদয় ছোঁয়া চারশত বছরের এক বটগাছ। ‘বনবিবি বটতলা’ নামে পরিচিত এই ঐতিহাসিক স্থানটি।
বটগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে মাটির সঙ্গে শেকড় তৈরি করে এটি বিশাল আকার লাভ করেছে। বহু পুরোনো এই বটতলায় সাধু ও ঋষিদের ধ্যানের স্থান ছিল। এখানে বিভিন্ন দেবদেবীদের পূজা অর্চনা করা হতো।
বর্তমানে এখানে আর সাধু ঋষিদের ধ্যান করতে দেখা যায় না, তবে বিনোদনের জন্য অনেক নারীপুরুষ এখানে ভিড় জমায়। উপজেলা পরিষদ থেকে স্থানটি মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানটির চারপাশে এখন বসতি গড়ে উঠেছে। তাই ধীরে ধীরে এই বটতলাটি তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু উপজেলার ঐতিহ্যটি সে আজো ধরে রেখেছে।
Advertisement
সুন্দরবনের বনবিবি মিথ সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানেন। এ-ও জানেন যে, ম্যানগ্রোভ বনের মহা শক্তিধর বাঘকে তাড়াতে বাওয়ালি, মৌয়াল ও জোংড়াখোটা সম্প্রদায় বনে ঢোকার আগে বনবিবিকে স্মরণ করেন। হিন্দু-মুসলমান, উভয় সম্প্রদায় বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের পূজা করে থাকেন।
এই মিথ বহু প্রাচীনকালের। দুর্ভাগ্যবশত, বনবিবি-পর্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে, আংশিকভাবে বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে এবং বেশিরভাগই প্রাকৃতিক সম্পদ তথা, সুন্দরী গাছ, মধু, গোলপাতা, মৎস্য, ঝিনুক প্রভৃতি অতিমাত্রায় আহরণের ফলে সুন্দরবনের অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক ধ্বংসের হার।
এই কিংবদন্তি কাহিনি জাঁকজমক হারিয়েছে এবং এই সংস্কৃতির চর্চা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মূলত দুটি কারণে: প্রথমত, মানুষের আগ্রাসনের কারণে সুন্দরবন দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত, মানুষের ভয়াবহ কার্যকলাপের কারণে বাঘের সংখ্যা তীব্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
অতীতে বাঘ মানুষকে বিরক্ত করলে আক্রমণ করত, কিন্তু এখন আক্রমণের অর্থ হলো মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে তারা তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব বোধ করছে। গ্রামবাসীদের নির্মম প্রহারে কথিত মানুষখেকো বাঘ আটকা পড়ে মারা যায়, এমনকি চোরাশিকারিদের গুলিতেও তাদের মৃত্যু হয়, যার ফলে তারা প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বাঘের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশ অভূতপূর্বভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ অংশে ২০০৪ সালে বাঘের সংখ্যা ৪৪০ গণনা করা হয়েছিল, কিন্তু ২০১৫ সালের গণনায় দেখা গেছে যে এক দশকে এই সংখ্যা কমে মাত্র ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে! এই দশকওয়ারী বিভাজনের ঘেরাটোপ অব্যাহত থাকলে, সুন্দরবনে কোনও বাঘ থাকবে না অচিরেই।
মানুষ যুগ যুগ ধরে পৌরাণিক কাহিনি তৈরি করেছে, এবং স্পষ্টতই বনবিবি এমন একটি পৌরাণিক কাহিনি যা একটি উদ্দেশ্য উদ্ভুত হয়েছিল। কিন্তু যদি বাঘই না থাকে তাহলে বন বিবিকে কোন্ পদ্ধতিতে পূজা করা হবে? এই পুজার আর আদৌ প্রয়োজন পড়বে কি না। বাঘের সংখ্যা ২০০৪ সালের পর থেকে যে হারে কমেছে, তা আশংকাজনক। বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস, বনদস্যু ও অবৈধ শিকারিদের কবলে পড়ে বাঘ নিঃশেষিত হচ্ছে।
যখন একটি বাঘ খাদ্যের সন্ধানে মানববসতিতে ঢুকে পড়ে তখন তাকে মানুষখেকো বাঘ আখ্যা দিয়ে জাল পেতে ধরে তাকে পিটিয়ে মারা হয়। মানুষ একবারও ভাবে না যে, এটি তাদের কারণেই ঘটছে। বাঘ আবাসস্থল হারিয়ে এবং গহিন বনে মানুষের আনাগোনায় বাধ্য হয়ে গ্রামে প্রবেশ করে।
প্রাচীনকাল থেকেই, জীবিকার জন্য বনে ঘুরে বেড়ানো মানুষের জন্য নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে পরিচিত বনবিবি। মধু আহরণ এবং কাঠ কাটার সময় তারা ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী বাঘকে ভয় দেখানোর জন্য বনবিবির নাম উচ্চারণ করে। উভয় অংশের জেলে-বাওয়ালি, মৌয়াল জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে প্রবেশের আগে, আল্লাহ’র নাম নেন। বিসমিল্রাহ বলেন। বনবিবির পূজা করেন। এমনকি অনেক কুফুরে কালামও পাঠ করেন বিসমিল্লাহ, কো-আল্লাহ প্রভৃতি বলে।
বনবিবির পূজা হয় হাজারো উপায়ে। এরমধ্যে পালা-পার্বণ, পূজা ও শিন্নি দান ও পুঁথিপাঠ অন্যতম। চটি বই আকারে অনেক পুরোনো পুঁথি পাওয়া যায়। পুঁথি ছাড়াও নানারকম মন্ত্র উচ্চারিত হয় বনচারীদের মুখে মুখে:“মা বনবিবি, তোমার বাল্লক এলো বনে,থাকে যেন মনে।শত্রু দুষমন চাপা দিয়ে রাখ গোরের কোণে।।দোহাই মা বরকদের, দোহাই মা বরকদের।”
এখন আসা যাক, এই মিথের সৃষ্টি কীভাবে। এই কিংবদন্তিটি এমন একটি নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত যে বনে জন্মগ্রহণ করে এবং বেড়ে ওঠার পর, বনবিবির প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ রায় (অর্থাৎ দক্ষিণের প্রভু)-এর ছদ্মবেশরূপী বাঘকে তাড়ানোর জন্য জঙ্গলে আবির্ভূত হতো। কাঠুরে বা মধু আহরণকারীরা দক্ষিণ রায়কে তাড়াতে এই বনবিবির নাম উচ্চারণ করতো।
বনবিবি ছিলেন ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) নামে আরবের এক কন্যা। ইব্রাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হলে সেখানেই বনবিবির জন্ম হয়। কথিত আছে, গুলাল বিবি মদিনা এবং ইব্রাহিম মক্কা হতে আগমন করেন। দক্ষিণ রায় ছিলেন যশোহরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনস্থ ভাটির দেশের সামন্ত। দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। শেষে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। দক্ষিণ রায়ের পরাজয়কে বাঘ বা অপশক্তির পরাজয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বনবিবি। অতীতকাল থেকে, জঙ্গলের কাছাকাছি বসবাসকারী বাসিন্দাদের একটি অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সহজলভ্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং তারা বাঘের শিকার হতো। বনবিবি, বা বনদেবী (জঙ্গলের দেবী), ব্যাঘ্রদেবী বা (বাঘদেবী)কে বনের রক্ষক আত্মা বলে মনে করা হয় এবং সুন্দরবন ও এর আশেপাশের হিন্দু ও মুসলিম উভয় গ্রামবাসীই বনবিবির পূজা করেন।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এই সুন্দরবন। এই ঐতিহ্যবাহী বন এখন চরম হুমকির মুখে। দুর্ভাগ্যবশত, বনবিবি কাহিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে, অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে সুন্দরবনের অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক ধ্বংসের কারণে।
সূত্রমতে, অতি সাম্প্রতিক সময়ে সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে ২০২৩-২০২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার বনে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া যায় ২.৬৪। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৫ সালের তুলনায় বাঘের সংখ্যা ১৭.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই বৃদ্ধির হার সুখবর হলেও আশানুরূপ নয়। কেননা, সুন্দরবনের সার্বিক ইকোসিস্টেম বিপর্যস্ত হয়ে গেছে মনুষ্য হস্তক্ষেপে ও অতি আহরণে। এখনই বাঘ বাঁচানোর সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের বাঘ। তখন আরেকটি মিথ প্রচলিত হবে–এই সুন্দরবনে একসময় বাঘ ছিল। বনবিবির পুজা হতো, পালা-পার্বণ হতো। উৎসব হতো। আজ কিছু নেই, বাতাসে ভেসে বেড়ায় শুধু হাহাকার।
আরও পড়ুন
চায়ের ইতিহাসে লুকিয়ে আছে শ্রমিকের নীরব কষ্ট সিলেটের মণিপুরী শাড়ি বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়লেখক: কথাশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও পরিবেশবিদ
সূত্র: খোলা কাগজ, বনবিবি উপাখ্যান-সিদ্ধব্রত দাস, দ্য বন বিবি মিথ-হাসান জাহিদ, দ্য এশিয়ান এইজ
কেএসকে/এমএস