ফিচার

গান গেয়ে অটোরিকশায় নকশা আঁকেন তোফা

গান গেয়ে অটোরিকশায় নকশা আঁকেন তোফা

গুনগুন করে গান গেয়ে আপন মনে অটোরিকশার বডিতে রঙ তুলির আঁচর কাটছেন এক যুবক। সুরটা বেশ শ্রুতিমধুর লাগছিলো, কাছে গিয়ে একটু জোরে গাইতে বললাম। গানটি অপরিচিত, এরকম কথায় আর সুরে গান আগে শোনা হয়নি।

Advertisement

গান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এরপর বললাম, বাহ্ চমৎকার গান! আমার দিকে ফিরেই তিনি এক ভূবন দোলানো হাসি দিলেন। বললেন, 'মিয়া ভাই গানটা আমারই করা (লেখা), সুরটাও আমার'। শুনে কিছুটা অবাক হলাম। বললাম, 'আপনি গান লেখেন? বললো জ্বী, আমি গান গেয়ে ভিডিও করে নেটেও (ইউটিউব) ছাড়ি'। পরক্ষণেই আবার বললো, 'আমার টাস (এন্ড্রয়েড) ফোন নাই। আরেকজনের ফোন থেকে ভিডিওগুলো নেটে ছাড়ি'।

পরনে পরিশ্রমে ময়লা হওয়া কাপড়, চেহারা মলিন হলেও মুখে তৃপ্তির হাসি। এরপর কথার ছলে জানতে পারি তার নাম তোফাজ্জল হোসেন তোফা। বয়স ৩৩ কিংবা ৩৪। বাড়ি বগুড়ার সোনাতলার আড়িয়াঘাট গুচ্চিগ্রামে। ভিটেমাটি না থাকায় সরকার ঘর পেয়েছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সেখানেই সুখে থাকছেন তোফা।

তোফা গান বাঁধার পাশাপাশি রিকশা, অটোরিকশায় পেইন্টিংয়ের কাজ করে। এসব কাজ তিনি চুক্তিভিত্তিক করে থাকেন। তিনি জানালেন, একটি বডি রঙ করতে তিনি ১৫০ টাকা নেন। তবে একেকটা বডিতে দৃশ্য আকাতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। মাঝে মাঝে আরও বেশি সময় লাগে।

Advertisement

আমি উদাস হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবি, 'এতো পরিশ্রম, এতক্ষণ কাজ করে মাত্র ১৫০ টাকা!’ কে জানে এতেই হয়তো তার তৃপ্তি। আমাদের চাহিদা ব্যাপক। তবে এই প্রত্যন্ত গ্রামে তোফার মত মানুষদের চাহিদা খুবই কম। কোনো মত খেয়ে-পরে থাকাই তাদের কাছে মুখ্য, এতেই তাদের সুখ।

তোফাকে জিজ্ঞাস করি, আচ্ছা দিনের এই চার/পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে এত কম মজুরিতে আপনার হয়? হাসিমুখে তোফা উত্তর দেন, ”আমরা গাঁও গেরামের লোক। ছোলপোল নিয়ে এই দিয়েই সুখে আছি। তাছাড়া আরও কিছু কাজ করি, আড়িয়াঘাট বাজারে ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছি 'তোফা আর্ট গ্যালারি' নামে। সেখানে ব্যানার, সাইনবোর্ডের কাজ করি। এ থেকে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আসে। এ দিয়েই সংসার চলে। সব পরিশ্রমের উপর ভাই। বেশি পরিশ্রম করলে বেশি আয়।” বলেই আবার হাসতে শুরু করলেন তোফা।

তোফা জানান, তিনি এক দিনে তিন থেকে চারটা অটোরিকশা রঙ করতে পারে। এছাড়াও পরীক্ষার সময় বাচ্চাদের প্রাক্টিক্যাল খাতাও অঙ্কন করে। তবে ডিজিটাল মেশিন আসায় হাতে আঁকা ব্যানার/ সাইনবোর্ডের কদর কমে গেছে। তারপরেও নাকি ভালোই কাজ পায় সে, বিশেষ করে স্কুলের কাজ।

কোথায় থেকে আঁকতে শিখেছে জিজ্ঞেস করলে তোফা বলেন, 'ক্লাস টু থেকেই আঁকাজোখা করতাম। আমাদের গ্রামের পাশে এনামুল ভাই আর্ট করতো। তার আর্ট দেখেই আর্ট শেখা'।

Advertisement

গ্রামের গরীব ঘরে জন্ম হওয়া তোফা বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেনি। মাত্র চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত হাতেখড়ি তার। এরপর ১০ বছর বয়সে কর্মের খোঁজে ঢাকা যান। সেখানেই রিকশা চালান। গ্রামে এসেও কিছুদিন ভ্যান চালান। পরে তার পুরোনো নেশা আর্টের দিকে মনোযোগ দেন। বর্তমানে এই আর্ট করেই তার সংসার চলে।

কথা শেষ হলে আবারও গান গাইতে গেইতে আপন মনে কাজে ঢুকে যান তোফা। সুর তোলেন- ''ভোলা মন, মনরে, ও ভোলা মনমাটির দেহ মাটি হবে, আমার শখের দেহ মাটি হবে মাটিরও ঘরে– মাটির দেহের কিসের বড়াই কর সংসারে গো, তোমরা শখের দেহের কিসের বড়াই কর সংসারে''

এএমপি/জিকেএস