উত্তরার আব্দুল্লাহপুরের পাইকারি মাছের বাজারে ভোরবেলায় তখন কাজ করি। এক পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীর সাথে। আমার কাজ হলো মাছের বক্সগুলো ট্রাক থেকে অন্যদের সাথে নামানো। নামানো শেষ হলে খুচরো ব্যবসায়ীদের মেপে বুঝিয়ে দেওয়া। কাজ শেষ করে মেসে ফিরে গোসল করে কলেজে যেতাম ক্লাস করতে। ক্লাস শেষে খন্দকার পেট্রোল পাম্পের পাশের দোকানে দুটা সিঙারা খেয়ে চলে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। আমি পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশের সাথে থিয়েটারে কাজ করছি ২০১১ সাল থেকে। টিএসসিতে নাটকের মহড়া শেষ করে রাতে মেসে ফিরতাম। তখনো বনানী আর কুড়িল ফ্লাইওভার হয়নি। তাই যদি ফাল্গুন পরিবহনে আসতাম; তখন কুড়িল বিশ্বরোড আর বনানী হয়ে আসলে বনানী রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘসময় ট্রেনের সিগন্যালে বসে থাকতে হতো। রাত ১১-১২টা বেজে যেত মেসে ফিরতে।
Advertisement
বাড়ি থেকে বাবা যে টাকা দিতেন, তা শুধু সেমিস্টার ফি দিতেই হিমশিম খেতে হতো। বাড়তি টাকা পেতাম না। তাই মেসের ভাড়া, খাবার ও আমার ব্যক্তিগত খরচের টাকা আমাকেই জোগাড় করতে হতো। নিম্নমধ্যবিত্তের উচ্চবিলাসী স্বপ্ন নিয়ে প্রাইভেটে পড়ালেখা করলে যা হয় আরকি। সেজন্য মাছের বাজারে, সুপারশপে, রংমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে, ভলেন্টিয়ারিং, বিনোদন ম্যাগাজিনে, সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। তখন কাজটাই প্রধান আর পড়ালেখা অপশনাল হয়ে গেলো। ক্লাসে সবার থেকে কম উপস্থিতি আমার। এমনো হয়েছে পুরো সেমিস্টারে কোনো সাবজেক্টে মাত্র দুটা ক্লাস করেছি। তবে কখনো পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট হয়নি। আমি কখনো সবগুলো বই কিনতে পারিনি। নতুন বই তো কেনার কথা চিন্তাও করতে পারিনি।
ভাড়া করা ড্রেস ও একটি প্রেজেন্টেশন তখন আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। মাঝখানে বছর তিনেক পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে পুনরায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। যেহেতু সব খরচের টাকা পয়সা নিজেকেই জোগাড় করতে হয় এবং হবে। তাই সেই টাকা জোগাড় করতেই এই বিরতি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, তাই খরচও বেশি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে স্পেশাল ছাড়ও দিয়েছিল আমার কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে। ছোট ভাইকেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি। তার খরচের অর্ধেক বাবাই দিতো। আর বাকিটা আমাকেই ব্যালেন্স করতে হয়।
চাকরি করি একটি মিনা বাজার সুপারশপে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বা দুপুর ১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। এখানে আমি ফিশ অ্যান্ড মিট ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। আমার কাজ ছিল ক্রেতারা যে মাছ কিনতেন; সেগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে কেটে দেওয়া। সিঁড়ির নিচে ছোট একটা জায়গা ছিল; সেখানে বসে বসে সারাদিন মাছ কাটতাম।
Advertisement
তাই ক্লাসে একমাত্র আমিই অনিয়মিত ছাত্র। যে কারণে শিক্ষকরা আমাকে চিনতেনই না। ক্লাসে গেলে শিক্ষক জিজ্ঞেস করতেন, আমি কি স্টুডেন্ট কি না। শিক্ষক ও সহপাঠীরা ভাবতেন, আমি ইচ্ছে করেই ক্লাসে অমনোযোগী। তাই আমাকে তারা ভালো চোখে খুব একটা দেখতো না। আমার এক স্যার পরীক্ষার আগে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ফাজিল ছেলেটা ক্লাসে কেন, দুদিন পরে পরীক্ষা। পরীক্ষায় কী লিখবে, অন্যেরটা দেখে লেখার সুযোগ আমি দেবো না। প্রতিটা ক্লাসে যে সিটগুলো দিয়েছি; সেগুলো তোমাকে দিয়ে তো লাভ নেই।’ সত্যি লাভ হয়নি। যদিও পাস মার্ক টেনেটুনে উঠেছিল।
গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের প্রেজেন্টেশনে ফর্মাল ড্রেস পড়তে হবে। নয়তো প্রেজেন্টেশনে দাঁড়াতে দেবেন না আগেই হুঁশিয়ারি করে দিয়েছিলেন শিক্ষক। আমার তো কোনো ফর্মাল ড্রেস নেই। নতুন কিনবো কীভাবে? যে টাকা পাই, তাতে অ্যাকাডেমিক ফি দিলে থাকা খাওয়ায় বাকি থাকে। থাকা খাওয়ার টাকা দিয়ে অ্যাকাডেমিক ফি বাকি থাকে। এভাবেই চলছে আর বাকি খরচ না বলাই ভালো। কখনো বন্ধুদের আড্ডায় থাকতে পারিনি, থাকলেই খরচ শেয়ার করতে হতো তাই। যে কারণে আমার বন্ধুও ছিল না।
অ্যাসাইনমেন্টের আগের দিন আনোয়ার ভাইয়ের লন্ড্রি থেকে একটা কালো টাই আর সাদা শার্ট ভাড়া করলাম। জুতা পাশের রুমের জিহাদের কাছ থেকে নিলাম, যদিও সাইজে একটু বড়। প্যান্ট, এই একটামাত্র জিনিসই নিজের ছিল সেদিন। যদিও আমাকে সেদিন প্রেজেন্টেশন দিতে দেওয়া হয়নি আমাকে। আমি অনিয়মিত ছাত্র ছিলাম বলে। যেহেতু গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাই আমাকে প্রেজেন্টেশন মার্ক থেকে বঞ্চিত করেননি স্যার।
(এভরেস্টজয়ী ইকরামুল হাসান শাকিলের টাইমলাইন থেকে নেওয়া)
Advertisement
এসইউ/জেআইএম