টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি লাল মাটির এলাকায় এড্রিক বেকার গড়ে তুলেছিলেন কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র বা গরিবের হাসপাতাল। ছায়াঘেরা সুনিবিড় গ্রাম্য পল্লি প্রকৃতিতে গড়ে ওঠা এ হাসপাতালে প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ বিরাজমান। শব্দ দূষণ কোলাহলমুক্ত নির্মল পরিবেশে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে ভিড় করেন।
Advertisement
এড্রিক বেকারের মৃত্যুর পর বর্তমানে আমেরিকার ডাক্তার দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানবিকতায় পূর্ণ চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীদের সেবা আর মনোরম পরিবেশেই অর্ধেক রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন এখানে। তবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা যায়, প্রকৃতির কোলে অরণ্যবেষ্টিত গ্রামের নাম হাগুড়াকুড়ি। মধুপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামটি। এই গ্রামে প্রতিদিন ছুটে আসে শত শত রোগী। আধুনিক চিকিৎসা নয়, আন্তরিক সেবার টানেই বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছেন রোগীরা।
আরও পড়ুন-
Advertisement
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বর্তমান নাম ডক্টর বেকার’স অর্গানাইজেশন ফর ওয়েল-বিং। মানবতা পূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইলের মধুপুরের দারিদ্র্যপীড়িত হিন্দু, মুসলিম, গারো-অধ্যুষিত এলাকায় স্থাপন করেন নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা ডা. এড্রিক বেকার। যিনি ডা. বেকার ভাই নামে দেশজুড়ে পরিচিত ছিলেন।
স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পান গরিবের ডাক্তার হিসেবে। টানা ৩৬ বছর চিকিৎসা সেবা প্রদানকালে গড়ে তোলেন নানা স্মৃতি। সখ্যতা গড়ে ওঠে গরিব-দুঃখী মানুষের সঙ্গে। স্থানীয় কয়েক জেলার মানুষেরা সরকারি-বেসরকারি সেবা গ্রহণের পাশাপাশি মাটির হাসপাতালেও সেবা নিতে আসে। এভাবে পিছিয়ে পড়া ওই এলাকা স্বাস্থ্য সেবায় দিন দিন এগিয়ে যায়। টানা ৩৬ বছর সেবা প্রদানকালে ২০১৫ সালে হাসপাতালেই মারা যান ডা. এন্ড্রিক বেকার। পরে হাসপাতালেই সমাহিত করা হয় তাকে।
তার মৃত্যুর পর হাসপাতাল নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অবস্থায় ২০১৮ সাল থেকে এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং হাল ধরেন আমেরিকান এক চিকিৎসক দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি। তাদের পরামর্শেই বর্তমানে চলছে মাটির ঘরের এ হাসপাতালের কার্যক্রম।
প্রতিদিন এখানে দেড়শ রোগীকে নামমাত্র মূল্যে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ইনডোরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। টাঙ্গাইল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন রোগীরা। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বেশি পরিচিতি। এছাড়া সব ধরনের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। হাসপাতালে বর্তমানে এমবিবিএস ডাক্তার ২ জন, ইন্টার্ন ডাক্তার ২ জন, নার্স ৬ জন, স্বাস্থ্য সহকারী ৩০ জন, ফার্মাসিস্ট ৩ জন, মিডওয়াইফ ৬ জন, গ্রাম্য স্বাস্থ্যকর্মী ১২ জন ও সাপোর্ট স্টাফ ১৮ জনসহ মোট ৭৯ জন কাজ করেন।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা যায়, রোগীরা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভিড় করছেন। কেউ টিকিট নিচ্ছেন, কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন, কেউ ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাচ্ছেন আবার কেউ এসেছেন চোখের চিকিৎসা নিতে। যক্ষ্মা রোগীদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। অনেক জটিল ও কঠিন রোগের প্রাথমিক পরামর্শ দিয়ে রেফার করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে অন্য মাটির ঘরে।
হাসপাতালে কর্মরত স্টাফ ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া ব্যক্তিরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এখানে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সুবিধা বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করার পাশাপাশি রোগীদের অবস্থা বুঝে হাসপাতালে ভর্তি রেখে সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।
রোগীরা বলেন, এই হাসপাতালের সুনাম শুনেই চিকিৎসা নিতে এসেছি। এই হাসপাতালের পরিবেশ ও সেবার মান সবই ভালো। ডাক্তার বেকারের গরিবের হাসপাতালের সেবা পেয়ে আমরা খুশি।
হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত জীবন বর্মণ জাগো নিউজকে বলেন, ১৭ বছর ধরে আমি এখানে রোগীদের নিয়ে কাজ করছি। বেশিরভাগ রোগীই গ্রাম থেকে আসেন। বেশি জরুরি রোগীদের ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ললিতা রেমা জাগো নিউজকে বলেন, আমি ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। নতুন রোগীদের কাছ থেকে ৩০ টাকা এবং পুরাতন রোগীদের কাছ থেকে ১৫ টাকা নেওয়া হয়।
জামালপুর থেকে আসা মোহাম্মদ কুদ্দুস নামের এক রোগী জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে ঠান্ডা ও কাশিজনিত সমস্যায় ভুগছি। এছাড়াও অল্প কাজ করলে হাপিয়ে উঠি। স্থানীয় চিকিৎসকদের দেখিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। তাই এখানে বিনামূল্যে ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছি।
একই জেলা থেকে আসা আরেক রোগী জোসনা মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে ডায়াবেটিস সমস্যায় ভুগছি। কিন্তু জামালপুরে ডাক্তার দেখিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এখানে চিকিৎসার মান ভালো শুনে ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছি। এখানকার সবার ব্যবহার খুবই ভালো।
হাসপাতালের কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার রিয়াজুল ইসলাম রিশাত জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এখানে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার নিশ্চিত করি। টাকার অভাবে যাতে গরিব মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ডাক্তার ভাইয়ের আদর্শ ধারণ করে আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক পিজন নংমিন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। এখানে আসা রোগীদের শতভাগই দরিদ্র। আমাদের প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। তাহলে সেবা আরও উন্নততর করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নিবন্ধিত ১৮০০ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। এদের মধ্যে ১ হাজার রোগীকে ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসক দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি জাগো নিউজকে বলেন, বেকারের মৃত্যুর পর গরিব মানুষদের আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এতে আমাদের অনেক ভালো লাগছে।
এফএ/জেআইএম