প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর কাছে একগুচ্ছ দাবি তুলে ধরেছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তার প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেছেন, বাজার উন্নয়নে যা করা প্রয়োজন তার সবকিছুই করবো।
Advertisement
রোববার (১৮ মে) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী নিকুঞ্জে অবস্থিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পরিদর্শনে এলে ডিএসই ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা পুঁজিবাজার উন্নয়নের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।
এ সময় বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, কমিশনার মো. মহসিন চৌধুরী, মো. আলি আকবর, পুঁজিবাজার সংস্কার বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডার- ডিবিএ, সিডিবিএল, সিসিবিএল-এর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডিএসই’র চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম দেশের পুঁজিবাজারের সামগ্রিক অবস্থা, ডিএসই’র কার্যক্রম এবং পুঁজিবাজারের কাঠামোগত বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, পুঁজিবাজারের বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনীতিতে পুঁজিবাজার ও অর্থবাজারের ভূমিকা মুখোমুখি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা, আইপিও প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন ও মূল্যায়ন, করপোরেট বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের পলিসি ও প্রক্রিয়াসমূহ সহজীকরণ, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট ও ডিসক্লোজারের নির্ভরযোগ্যতা, বাজারের মধ্যস্থতাকারীদের সক্ষমতা ও সুশাসন, ইনসাইডার ট্রেডিং, সার্ভেইল্যান্স ও পুঁজিবাজারের জন্য পলিসি সাপোর্ট।
Advertisement
বর্তমানে পুঁজিবাজারের পতনের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি সিকিউরিটিজের অধিক সুদের হার, করপোরেট প্রফিট হ্রাস, নেগেটিভ ইক্যুইটি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং ম্যানিপুলেটরের ভূমিকা।
আরও পড়ুন শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ নির্দেশনা ২০ বছর পর শেয়ারবাজারে শনিবার লেনদেন, শুরুতেই দরপতনপুঁজিবাজারের আস্থা বৃদ্ধির জন্য করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, বিও হিসাবের মেইনটেন্যান্স ফি ছাড়, ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স মওকুফ, ব্রোকারেজ কমিশনের সর্বোচ্চ হার ০.৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৩৫ শতাংশ করা, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ এক লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত করা এবং লভ্যাংশের উৎসে কর ১০ শতাংশ বা ১৫ শতাংশ চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচনা করা, নেগেটিভ ইক্যুইটির বোঝা থেকে বিনিয়োগকারীদের মুক্ত করা, প্রতি এক লাখ টাকার অগ্রিম আয়কর ৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা করা, সিসি অ্যাকাউন্টের লভ্যাংশ ২৫ শতাংশ ইনভেস্টর প্রটেকশন ফান্ডে জমা রেখে বাকি অংশ ব্রোকারদের ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া, নেগেটিভ ইক্যুইটি ধীরে ধীরে প্রভিশনিং করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য নিয়ন্ত্রক ও বাজার মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে প্রতি মাসে যৌথ বেঠকের আয়োজন করা, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবধান ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা, বহুজাতিক ও ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন দেশীয় কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা, পুঁজিবাজারে থেকে অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ ডিজিটালাইজ করা, করপোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে অ্যাসেট ব্যাকড সিকিউরিটিজের আয়কে করমুক্ত করা এবং কোম্পানির ৫০০ কোটি টাকার উপরে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে আইপিও/বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিাবাজার থেকে মূলধন উত্তোলন বাধ্যতামূলক করা।
সরকারের ম্যাক্রো চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার সম্পর্কে মমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারের হাতে থাকা বহুজাতিক ও লাভজনক বেসরকারি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার, সরকারের হাতে থাকা ব্যাংক, বিমা, বিমানসহ বিভিন্ন কোম্পানি বেসরকারিকরণ করা- যেখানে শর্ত থাকবে যে ২৪ মাসের মধ্যে তা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে, সরকার তার বিভিন্ন প্রাপ্যগুলোকে সিকিউরিটাইজেশন করতে পারে যা পরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে, সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারি জমিতে আবাসন প্রকল্পসমূহকে রিয়েল স্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের মাধ্যমে করা যেতে পারে যা বিশ্বখ্যাত ফান্ড ম্যানেজাররা পরিচালনা করবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য পুঁজিবাজারের মাধ্যমে বন্ড ইস্যু করতে পারে।
ডিএসইর চেয়ারম্যান পুঁজিবাজার সংক্রান্ত পলিসিগত সিদ্ধান্তের নেওয়ার ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের ন্যূনতম একজন প্রতিনিধি রাখার ব্যাপারে অনুরোধ করেন এবং ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী এ ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
Advertisement
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সরকার পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কার নিশ্চিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা দেশের উন্নয়ন ও সংস্কার তথা পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন। দেশের অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধসহ অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটছে। এসবের প্রভাব শিগগির পুঁজিবাজারে পড়বে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজারের শক্ত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পুঁজিবাজারকে শক্ত কাঠামোয় গড়ে তুলতে পারলে শিল্পোন্নয়নে পুঁজি সংগ্রহের পথ সহজ হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও আর্থিক মূলধন সবই বিদ্যমান। শুধু দেশ প্রেমের মানসিকতায় এগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপাইনস এর উদাহরণ দেন।
তিনি আরও বলেন, ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির জন্য বিএসইসি চেষ্টা করছে। পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্ক ফোর্সের সুপারিশের আলোকে খুব দ্রুতই পাবলিক ইস্যু রুলসের সংস্কার করা হবে, যা ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। পুঁজিবাজারে বিদ্যমান যেসব প্রতিবন্ধকতা আপনাদের বা বিএসইসি এবং ডিএসইর আওতার মধ্যে আছে সেগুলো আপনারা সমাধান করুন। আর যে বিষয়গুলো আপনাদের আওতার বাইরে সেগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করুন। আমার পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। আমি আপনাদের সব কথাই শুনবো এবং বাজার উন্নয়নে যা করা প্রয়োজন তার সবকিছুই করবো।
এছাড়াও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা বাজার উন্নয়নে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্রাকচার, এসএমই মার্কেট, এটিবি মার্কেট, বিও অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধি, মার্কেটে পার্টিসিপেন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করা, সিসিবিএল-এর বাস্তবায়ন, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয় বৃদ্ধি, দীর্ঘদিনের পুরোনো আইনগুলো যুগোপযোগী করা, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন রিভিউ করা, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের উন্নতি, তালিকাভুক্তি কোম্পানির কর হার হ্রাস, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির ট্যাক্স সুবিধা, সরকারি শেয়ার পুঁজিবাজার আনা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঋণ সহায়তা, ব্রোকার কমিশন, ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি, মার্কেট পলিসি, নেগেটিভ ইক্যুইটি এবং সিসি অ্যাকাউন্টসহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ এবং পুঁজিবাজার উন্নয়নে গত ১৭ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. সাদেকুল ইসলাম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বীমা ও পুঁজিবাজার অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাঈদ কুতুব ও কমিটির সদস্য সচিব বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ।
এমএএস/ইএ/জিকেএস