প্রবাস

বিবেকের পরিচয়ে বিশ্ব নাগরিক হন

বিবেকের পরিচয়ে বিশ্ব নাগরিক হন

একজন লোকাল বাসে উঠে পকেটমারের মতো চালাকি করে সরকারি টেন্ডার নেয়। পাশে বসা একজন তরুণ জানে— এটিই অন্যায়। কিন্তু সে চুপ। পাশের সিটে বসা আরও একজন নারী বললেন, ‘দেশ তো এমনি চলে, তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না।’এভাবেই একদিন কেউ দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়, আর কেউ হয়ে ওঠে নিশ্চুপ সাক্ষী। কিন্তু কেউ কি বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পারে? শুধু পাসপোর্টে নাম লেখা থাকলে কি হয়ে ওঠা যায় ‘পৃথিবীর মানুষ’?

Advertisement

একটি ছোট প্রশ্ন, বিশাল জবাব: দুর্নীতিবাজ হওয়া এত সহজ, আর বিশ্বনাগরিক হওয়া এত কঠিন কেন? কারণ দুর্নীতির জন্য প্রয়োজন হয় না বিবেক, প্রয়োজন হয় কৌশল আর চুপ করে থাকার মানসিকতা। আর বিশ্বনাগরিক হওয়ার জন্য লাগে আত্মবিশ্বাস, নৈতিক দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস এবং ভালোকে ধারণ করার ধৈর্য।

বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দুর্নীতিকে প্রথা হিসেবে গ্রহণ করে ফেলে — অফিসে, স্কুলে, হজে, পুলিশি কাগজে, এমনকি হাসপাতালে। তারা নিজেকে ‘চালাক’ ভাবে। অথচ বিশ্বনাগরিক হতে হলে নিজেকে চালাক নয়, মানুষ হতে হয় — এমন মানুষ যার কাছে অন্যায়ের কোনো দেশ নেই, এবং ন্যায়ের কোনো সীমানা নেই।

বিশ্বনাগরিক মানে এমন একজন মানুষ: যিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে, কিন্তু শান্তির পক্ষে শুধু কথায় নন, কাজে। যিনি রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিনি, সুদানি কিংবা ইউক্রেনীয় — কাউকে কেবল ‘ওদের সমস্যা’ বলে দূরে ঠেলে দেন না। যিনি নিজ দেশের অন্যায় দেখেও বলেন, ‘না, আমি একমত নই।’ যিনি জানেন, একটি ভালো পৃথিবী গড়ার জন্য ভোট, ভাত এবং প্রতিবাদ — তিনটিই সমান জরুরি। বাংলাদেশের তরুণরা কীভাবে বিশ্বনাগরিক হতে পারে?

Advertisement

প্রথমত, প্রতিদিন অন্তত একবার নিজেকে প্রশ্ন করো, ‘আমি যা করলাম, তাতে মানবতা লাভবান হলো তো?’ দ্বিতীয়ত, ‘আমার দেশ সেরা’ বলার চেয়ে ‘আমার দেশকে আরও ভালো করব’ বলাটা বেশি দায়িত্বশীল এবং সম্মানজনক।

তৃতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্রতম অবস্থান থেকেও লড়ো — না বলা, প্রতিবাদ করা, ফাঁস করে দেওয়া — এগুলো ছোট পদক্ষেপ, কিন্তু দুনিয়া বদলায় এতে করেই। চতুর্থত, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, পরিবেশ, মানবাধিকার — যেকোনো খাতে নিজেকে এমনভাবে গড়ো, যেন তুমি শুধু দেশের নয়, বিশ্বের সম্পদ হও।

ত্যাগ করো: ‘সবাই করে’ — এই ভয়ংকর আপসবাদী মানসিকতা। পরিচয়ের গোঁড়ামি: ধর্ম, ভাষা, অঞ্চল ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে মাপা। লোক-দেখানো দান, চ্যারিটি বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব — অন্তর থেকে বিশ্বাস না থাকলে তা ভণ্ডামি। নৈতিকতাকে দুর্বলতা ভাবা — সত্য বলাই শক্তির বড় প্রকাশ।

একটি আত্মজিজ্ঞাসা—‘আমি কি মানুষ? নাকি পরিচয়ের মুখোশে ঢাকা এক সুবিধাবাদী সত্তা?’ বিশ্বনাগরিক হওয়া মানে কেবল একগুচ্ছ কাগজ নয়। এটা মানে— বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা, হৃদয় দিয়ে অনুভব করা এবং সাহস দিয়ে কাজ করা। আজ, আপনি হয়ত বাংলাদেশের একজন নাগরিক। আপনার পাসপোর্টে দেশের নাম আছে, ভোটার আইডিতে বাবার নাম। কিন্তু আপনার বিবেকের পাসপোর্টে কী লেখা আছে?

Advertisement

আপনি যখন দুর্নীতিকে না বলেন, তখন আপনি কেবল সৎ নাগরিক নন — আপনি পৃথিবীর পক্ষে একজন যোদ্ধা। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়াটাই ভবিষ্যতের একমাত্র সম্মান। আমি কি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী? না, কারণ আমি তাদের কাপ অফ চা না! একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির খবর আমার কানে আসে। আমি চুপ থাকিনি। উলটো যুদ্ধ ঘোষণা করেছি — সরাসরি, প্রকাশ্যে।

সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের, স্বার্থান্বেষী কর্মচারীদের এবং ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাবাদী প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাই।কিন্তু আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হলো— জনগণকে পাশে ডাকলাম, তারা এড়িয়ে গেলো। তারা কেউই প্রতিবাদ করেনি বরং এমনভাবে পাশ কাটিয়ে গেল যেন আমি কোনো অচেনা আগন্তুক। তখনই মনে হলো—আমি কি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী? না। আমি তাদের কাপ অফ চা না।

এই একটি বাক্যই আজকের প্রতিবেদনটির কেন্দ্রবিন্দু। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানেই শুধু নৈতিক শক্তি নয়, সমাজের নিঃসঙ্গতা সহ্য করার প্রস্তুতিও। বিশ্বনাগরিক হওয়ার অর্থ— নিজের ছোট পরিসরের সুবিধা বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। এই মূল্যবোধের সঙ্গে কখনো জনগণ যাবে, কখনো যাবে না। কখনো আপনি হবেন নায়কের মতো, আবার কখনো হবেন একলা পাগল।

আজকের বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কণ্ঠ নয়, দুর্নীতির সঙ্গে ‘মিশে যাওয়াই’ বুদ্ধিমানের পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো শত শত প্রতিষ্ঠান আজ জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে— যারা প্রশ্ন করে, তাদের বলা হয় ‘তুই কার হয়ে কথা বলিস?’ যারা প্রতিবাদ করে, তারা হয়ে ওঠে ‘দলবিরোধী’ বা ‘উগ্র’। আমার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে— জনগণ সবসময় ন্যায়ের পক্ষে থাকে না। অনেক সময় তারা নীরবতার আড়ালে নিজেরাই অন্যায়ের শরিক হয়।

কেন এমন হয়? ভয় — অধিকাংশ মানুষ ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় পায়। অপেক্ষাকৃত লাভবান থাকার মানসিকতা — তারা ভাবে, ‘এখন কিছু না বললে আমার ক্ষতি হবে না।’ গা-ছাড়া সংস্কৃতি — ‘আমার না হলে তোরও না হোক’ — এই আত্মকেন্দ্রিকতা সমাজে নৈতিক রসদ শূন্য করে ফেলেছে।

তবু আমি দাঁড়িয়েছি কেন? কারণ আমি একজন বিশ্বনাগরিক — আমার পরিচয় কেবল জাতীয়তা নয়, নৈতিকতা। আমি জানি, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই কখনো কখনো একা হওয়া। কিন্তু আমি এটাও জানি — ইতিহাসে প্রতিটি পরিবর্তন একা কোনো পাগলের হাত ধরেই এসেছে। সুবিধাভোগী নাগরিক বনাম বিশ্বনাগরিক — এক নৈতিক সংঘাতের আয়না। সুবিধাভোগী নাগরিকদের মূল্যবোধ গঠিত হয় দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিগত লাভের ভিত্তিতে।

তারা চায় এমন একটি সমাজ, যেখানে নিজে কিছু সুবিধা পেলেই বাকিদের কথা ভুলে যাওয়া যায়। অন্যদিকে, বিশ্বনাগরিকের মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু হলো মানবিকতা ও নৈতিকতা। সুবিধাভোগী নাগরিক কখনো প্রতিবাদ করে না। বরং ক্ষমতার মুখ দেখে চুপ থাকে। অন্যদিকে, বিশ্বনাগরিক সত্য দেখলে চুপ থাকতে পারে না। সুবিধাভোগীর মনে সবসময় ভয়ের ছায়া। কিন্তু বিশ্বনাগরিক জানে, ভয়কে জয় না করলে সমাজ জয়ের স্বপ্নও দেখা যায় না।

সুবিধাভোগীর উদ্দেশ্য নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। বিশ্বনাগরিক চায় বৈষম্যহীন, সুবিচারভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তুলতে। এই চারটি বৈশিষ্ট্য আমাদের সমাজের আয়নাটা স্পষ্ট করে তোলে। প্রশ্ন হলো— আমরা কে হতে চাই? এক সুবিধাভোগী নাগরিক, যে নিজের সুবিধা পেলেই চুপ? না কি, এক বিশ্বনাগরিক, যে সত্যের জন্য সাহস করে দাঁড়ায়, একা হলেও? এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে—বিশ্বনাগরিক হওয়া মানে শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেওয়া নয়; এটি মানে নিজ পাড়ায়, নিজ এলাকায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এমনকি যদি কেউ পাশে না থাকে তবুও।

আমার একক প্রতিবাদ আজ হয়ত সমাজ বদলাবে না, কিন্তু তা ভবিষ্যতের একজন তরুণকে নীরবতা ভাঙার অনুপ্রেরণা হতে পারে। আমি কারো কাপ অফ চা না, কারণ আমি অন্যের মতো তেল-মাখানো চা খেতে শিখিনি। আমি নিজের বিবেক দিয়ে গড়া এক তিক্ত কিন্তু বিশুদ্ধ চায়ের কাপ — যা পান করে ঘুম ভাঙে, সত্য জাগে। আমি একা যদি একাও থাকি, তবে আমি সঠিক সিদ্ধান্তেই আছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় গৌরব। এখন ভাবুন—আমরা যদি সবাই চুপ থাকি, সত্য কার কাছে যাবে? আপনি চুপ থাকবেন, না চলবেন?

—রহমান মৃধাগবেষক এবং লেখকসাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনRahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এমএস