বাড়ির প্রবেশ পথেই হানিফার ঘর। ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই হানিফার দুই ছেলের সঙ্গে দেখা। ওরা আগতদের মুখের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকায়। হয়তো ওদের বাবার খবর নিয়ে এসেছে কেউ। ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসেন হানিফার মা। খানিক দূরে ব্যস্ত থাকা হানিফার বাবা, প্রতিবেশী, পথচারী সবার চোখে-মুখে স্পষ্ট কৌতূহল। কোনো খবর কি এলো-এত বছর পরে…।
Advertisement
মো. হানিফা। দেখতে ছিলেন বেশ কালো। তাইতো গ্রামের সবাই তাকে কালাভাই বলে ডাকতেন। দেখতে কালো হলেও তার অন্তরটা ছিল বেশ পরিষ্কার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন। সবাইকে সমাদর করতেন। এলাকার মুরব্বিদের কাছে তার বেশ কদর ছিল। কিন্তু সব মায়া কাটিয়ে ২০১৮ সালে ৪০ বছর বয়সে নিখোঁজ হন এই জেলে।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পূর্ব বাদুরতলা গ্রামে নিখোঁজ জেলে মো. হানিফা মাঝির বাড়ি। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজের পর কেটে গেল প্রায় সাত বছর। এরপর বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুন সংসার সাজিয়েছেন হানিফার স্ত্রী। তবে এই ছয় বছর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন হানিফার সন্তানরা। বাবাহীন সন্তানরা আর জীবনকে গোছাতে পারেনি। বরং অবর্ণনীয় কষ্টের প্রহর গুনেছে শিশুগুলো।
হানিফা মাঝির তিন ছেলে। হানিফার রেখে যাওয়া সেই তিন শিশুর একজন বর্তমানে সাবালক। বাকি দুইজনই এখনো শিশু। বড় ছেলে ইয়াসিনের বয়স ২৩। বাবা নিখোঁজ হাওয়ার সময়কালে তার বয়স ছিল ১৬। এখন সে বিয়ে করেছেন। এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর আর হয়নি। মেঝ ছেলে ইসহাকের বয়স ১৭। নবম শ্রেণিতে পড়ছেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে বাবার সঙ্গে শেষ দেখা। ছোট ছেলে ইসার বয়স ১১ বছর হলো। এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা যখন চলে গেলেন তখন স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি ওর।
Advertisement
হানিফার স্ত্রী রীনা। বাস্তবতা সন্তানদের থেকে এই নারীকে ঠেলে দিল দূরে, অন্য কোনো পুরুষের ঘরে। হানিফ নিখোঁজের পর তার অন্যত্র বিয়ে হয়। রীনার বাবা-মায়ের পিড়াপিড়িতে পেটের দায়ে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হন। তবে খোঁজ-খবর নেন তার প্রথম ঘরের তিন সন্তানের। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যান নারী ছেড়া তিন রত্নের মুখ। কিন্তু এতে মন ভরে না সন্তানদের। আবার কিছুই যে বলার নেই, কিছু করারও নেই। এমন জীবন মেনে নিতে হয়েছে। ইয়াসিন-ইসহাক-ইসা এখন বোঝে বাবা থাকলে আজ ওরা মাকেও কাছে পেত। তাইতো বারবার ওদের বাবাকে মনে পড়ে। বাবার ওপর ওদের রাগও হয়, এত পেশা থাকতে কেন জেলে হতে হলো? কেনই বা নিখোঁজ হতে হলো? কেনই বা এমন দিন দেখতে হলো?
কথায় বলে, অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগরও শুকিয়ে যায়। এই তিনটি শিশুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। বাবা নিখোঁজ আর মায়ের অন্যত্র বিয়ের পর শিশুগুলোর জায়গা হয় চাচা-চাচির ঘরে। দুই বছর যেতেই ফের ভাঙন। সেই চাচিও মারা গেলেন। এরপর চাচাও আরেকটি বিয়ে করেছেন। থাকেন নতুন শ্বশুরবাড়ি। মৃত ওই নারীরও ছিল দুই মেয়ে। চাচা-চাচির সেই দুই মেয়েসহ হানিফার তিন শিশু হলো আশ্রয়হারা। শেষ ভরসা বৃদ্ধ দাদা-দাদি। সেখানেই ৫ শিশুর শেষ আশ্রয় হয়।
হানিফার বাবা আবু কালাম (৬৫) একজন জেলে। মা-মিনারা খাতুন (৫৯) গৃহিণী। বয়সের কাছে নতযানু তারাও। কি করে সামলাবেন এই ৫ নাতিকে? যদিও এখনো সামলে রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু তা নামেমাত্র। অধিকার-প্রয়োজন-বিনোদন সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা যাকে বলে। অনাহারে-অর্ধাহারে পাঁচ নাতিসহ চলতে থাকে দুই বৃদ্ধা।
হানিফার বাবা বলেন, ওদের ট্রলার যখন পড়লো (ডুবলো), আমিও সাগরে ছিলাম। অন্য বোটে মাছ ধরছিলাম। তিনদিন পরে আমি যখন ঘাটে ফিরলাম, তখন শুনলাম-আমার হানিফা আর নেই। এরপর সাগরে খুঁজতে যাই। চারটি ট্রলার নিয়ে খুঁজতে গেলাম। ভাসমান অবস্থায় কয়েকজনকে পাওয়া গেল। আমার বাবোরে (ছেলেকে) আর পাওয়া গেল না। আটজন মানুষ কোথায় গেছে-কইতে (বলতে) পারি না। হানিফাদের ট্রলারের মাঝি এখনো বেঁচে আছেন। সেদিন কীভাবে যে কী হলো এখনো বলেনি। যারা ফিরেছেন, তারা বলেছেন-ট্রলার ডোবার পর আমরা সাতরে কূলে উঠেছি। কে কোন দিকে গেল জানি না।
Advertisement
তিনি বলেন, ছেলে নিখোঁজ হলো সাত বছর। এরপর থেকেই নাতিগুলোর জীবনে কষ্ট শুরু। লেখাপড়া করছে নামেমাত্র। ওদের চোখের দিকে তাকানোই কষ্টকর। হানিফের মা মিনারা খাতুন বলেন, যেদিন হানিফা যাবে, সেদিনও আমার জন্য আম কিনে আনলো। সন্ধ্যার দিকে বিদায় নিয়ে সমুদ্রে গেল। পরদিন দুপুরে খবর এলো ‘ট্রলার ডুবেছে’। এরপর অন্য বোট নিয়ে খুঁজতে গেল। ১০ জনকে পাওয়া গেল। আমার ছেলেরে পাওয়া গেল না। আর তো ফিরল না। একবছর পর বাচ্চাগুলোর মা অন্য যায়গায় বিয়ে বসলো। এখন নাতি আমরাই পালি। কষ্ট হয়, ঠিকভাবে পড়াতেও (লেখাপড়ার খরচ দিতে) পারি না।
মো. হানিফার মা মিনারা খাতুন এখনো ছেলে ফিরে আসবে সেই আশায় বুক বাঁধেন
অন্যত্র বিয়ে করলেও ভাগ্যচক্রে প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় হানিফার স্ত্রী রীনা বেগমের। কথা হয় আর আগের সংসার-স্বামী ও সন্তান প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, সেবার সমুদ্রে যেইতে (যেতে) চাইছিল না। বলেছিলেন ইয়াছিনের মা, আমার মন টানে না। যাবার আগে অনেক কথা বলছে। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব মিল ছিল। আমার স্বামী অনেক ভালো ছিল। আমার ছেলেদের খোকা ছাড়া ডাকতেন না। তিনি বলেছিলেন, আমার ছেলেরা যেন কোনো কষ্ট না পায়। আমার ছেলেদের দিকে তুমি সব সময় খেয়াল রাখবে। অথচ পেটের দায়ে আমি কথা রাখতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, পেটের জন্য নারীদের অনেক কিছুই করতে হয়। আমার দ্বিতীয় বিয়ে করা লাগছে। আমার বাপ-মায়ে নিয়ে আমারে দ্বিতীয় বিয়ে দিয়েছে। আমি কিছুই করতে পারিনি আমার ছেলেদের জন্য। আমার ছেলেদের কপালে যা ছিল তাই হইছে। আমার কপাল খারাপ, আমার এই বয়সে আমার স্বামী নিখোঁজ হইছে। ছেলেরা এতিম হইছে।
হানিফার মেঝ ছেলে ইসহাক বলেন, বাবা চলে যাওয়ার পর চাচাও পর হয়। দাদা-দাদি বৃদ্ধ। দাদা মাছ ধরে, খেতে খামারে কাজ করে যা পায়, তাতে কোনো রকম পেট চলে। ঘরের খাবার যোগাড়েই কষ্ট, এর মধ্যে দাদা-দাদির কাছে আরেক কষ্টের কারণ ‘আমরা’। তাই কোনো কাজ পেলে করি। আব্বায় থাকলে এত কষ্ট করা লাগত না। আমাদের কপালে ছিল এমন…
অশ্রুঝড়া চোখে ইসহাক বলে, আমার বাবা যেদিন শেষ গেলেন, তখন আমি ঘুমে ছিলাম। মনে পড়ে আইয়া (ঘরে ফিরেই) বোলান (ডাক) দিত। আমাগো খোকা কইয়া বোলান দিত। হেরে (তাকে) দেখলেই দৌড়াইয়া যাইয়া (দৌড়ে) কোলো উঠতাম।
ছোট্ট ইসা বললো, বড় ভাই অনেক কষ্টে এইচএসসি পাস করেছেন। কোনো চাকরি পায়নি। এখন যখন যে কাজ পায়, তাই করেন। আমাদের পড়ালেখা করার তাগিদ দেন। স্কুলেও যাই। মা নাই, আব্বায় নাই…। মায়ের হয়েছে দ্বিতীয় বিয়ে, আব্বারে খুব মনে পড়ে।
জেলে জনপদে এমন কষ্ট বয়ে বেড়ানো শিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার। শিশু হলেও শিশু অধিকার সম্পর্কে জানে না যারা। জানার প্রয়োজনও নেই ওদের। অধিকারে ওদের কোনো আবদার নেই। ওদের জন্মই যেন কষ্ট বয়ে নিতে। এই কষ্ট দেখার যেন কেউ নেই। রাষ্ট্রের উদ্যোগও চোখে পড়ে না।
গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে প্রতিবছর অনেক জেলে নিখোঁজ হন। এদের কারো লাশ ফিরে আসে পরিবারের কাছে, অনেকের পরিবার জানতেই পারে না নিখোঁজ জেলে বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। বহু বছর পরে কালেভদ্রে দু’একজন ফিরে আসে বলে হতভাগ্য পরিবারের সদস্যরা আশায় বুক বাঁধেন-হয়তো একদিন ফিরবে তার স্বজন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। আজো অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি হানিফার পরিবার ও সন্তানদেরও। এখনো কাঁদে ওরা- বাবার অপেক্ষা শেষে।
হানিফার ঘরটা খসে খসে পড়েছে। এখন সেটা বসবাস অনুপযোগী। তবুও সন্তানরা ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে-দেখে। হয়তো একদিন এই ঘরটার চিহ্নও থাকবে না। ঘরটার মতোই যদি বাবার স্মৃতিগুলো মনে থেকে দূরে চলে যেত, তবে হয়ত কাঁদতে হতো না। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। বাবাকে তো মোছা যায় না। বাবার স্মৃতি ফুরায় না।
আরও পড়ুন
কয়লা শ্রমিকের ঘামে জ্বলে উঠে শহরের বাতি প্রেম-পরিবার-প্রজন্ম সবই জলের সাহচর্যেকেএসকে/এমএস