দিনান্তে সব পাখি ঘরে ফেরে। সারাদিনের কাজ, দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে সন্ধ্যায় মানুষ ঘরে ফেরে। সে চায় বন্ধ দরজায় করাঘাত করলে ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিবে। সে ফিরবে তার আপন কুলায়। দেখা হবে তার প্রিয় স্বজনদের সাথে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটা ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলবে “হোম সুইট হোম।” এটাই আমাদের পরিবার। আমাদের নিঃশেষে স্বচ্ছন্দ্য হওয়ার নিশ্চিত ঠাঁই।
Advertisement
আজকের এই পরিবার দিবসে আপনি যখন সকালে ঘুম থেকে জেগে এককাপ চা হাতে বারান্দায় বসে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন, বিশ্বে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তখন পরিবারহীন। এই মানুষগুলোর কাছে “পরিবার” শব্দটি একটি বিলাসিতা, এই শব্দটি তাদের কাছে মহা মূল্যবান। শুধু কেউ এসে নিয়ে যাবে বলে, একটি পরিবার পাবে বলে এতিমখানার একটা শিশু বছরের পর বছর অপেক্ষা করে। মায়ের আঙুল ধরে যখন একটি শিশু জ্যাকসন হাইডসের পার্কে খেলায় মগ্ন, তখন অন্য একটি শিশুর বুক চিরে বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস!
আমাদের সাউথ এশিয়ান ভূখণ্ডে পরিবার বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক সেরকম বিশ্বের সব দেশে নয়। একেকটা দেশে এক এক রকম পরিবার প্রথা দৃশ্যমান। পঁচিশ বছর বয়সের সন্তানের শিক্ষা কিংবা ভরণ পোষণের দ্বায়িত্ব যেখানে আমরা পিতামাতার কর্তব্য মনে করি সেখানে পাশ্চাত্য দেশের যে কোনো সন্তানের আঠারো বছর হলে দ্বায়িত্ব তার নিজের কাঁধেই বর্তায়। সে গড়ে তোলে তার স্বতন্ত্র জীবন। আয় রোজগার থেকে শুরু করে সঙ্গী নির্বাচন সব কিছু সে তার নিজের ইচ্ছে মতই করতে পারে। অন্যদিকে আমরা যূথবদ্ধ পারিবারিক প্রথায় বিশ্বাসী। আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে অন্য পরিবারে চলে যেতে দিলেও ছেলে সন্তানকে নিজেদের কাছে আটকে রাখতে পছন্দ করি। এর মন্দ-ভালো দুই দিকই রয়েছে।
আমার এক কলিগের সাথে একবার তার পরিবার নিয়ে কথা হচ্ছিলো। ওর নাম জোয়ানা। তো, জোয়ানা বলছিলো, ওরা চার ভাইবোন কিন্তু প্রত্যেকেরই বাবা আলাদা। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, জোয়ানা, “তোমার বাবার সাথে কি তোমার প্রায়ই দেখা হয়?” সে উত্তরে জানিয়েছিলো, জোয়ানা তার বাবাকে কখনোই দেখেনি। শুধু তার মায়ের সাথে ফটোতে দেখেছে।
Advertisement
আমি সাউদার্ন আফ্রিকার একটি দেশে থাকি। এখানকার পরিবার কাঠামো দেখে প্রথম প্রথম আমি খুব বিস্মিত হতাম! এখানে “বিয়ে” প্রথাটা খুব কম। নারী ও পুরুষ নিজেদের পছন্দ ভিত্তিক সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভূত পারিবারিক জীবনে বেশি অভ্যস্ত। এই পরিবারে জন্ম নিচ্ছে সন্তান। আবার যখন তাদের বনিবনা হয় না তখন তারা স্বেচ্ছায় আলাদা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সন্তানের দ্বায়িত্ব সাধারণত মায়ের উপরই বর্তায়। কিন্তু মা ক্লেইম করলে শিশুর পিতাকে দিতে হয় একটা মাসিক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ।
এখানে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা বোগাদী বা লোবোলা নামক এক প্রথা মেনে বিয়ে সাদিতে সম্মত হয়। এই প্রথায় বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে বিশেষ করে কন্যার পিতাকে বিয়ের আগেই আটটা গরু কিংবা তার সমমান টাকা উপহার দিতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ জোগাড় করা সকল পুরুষের পক্ষে খুব সহজ নয়। তাই তারা বিয়ে না করেই প্রেমজ সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিবার গড়ে তোলে। একটি পরিবারে নারী, পুরুষ উভয়েই উপার্জন করে সংসারের ব্যয় বহন করে। জন্ম নেয় সন্তান সন্ততি।
আবার কখনো মতের অমিল হলে যে যার পথ ধরে। ছোট শিশু মাত্রই মায়ের উপর নির্ভরশীল তাই শিশুরা মায়ের কাছে থাকে। যেহেতু নারীটিকে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাই অনেক সময় নারীটি চলে আসে শহরে, যেখানে কাজ পাওয়ার সুবিধা বেশি। আরেক জন পুরুষ সঙ্গীর সাথে থাকার আগে পর্যন্ত তারা সাধারণত কন্ডোতে তাদের ঘর সাজায়। কন্ডো হচ্ছে ছোট পরিবার বা একা থাকার উপযোগী একটি ফ্ল্যাট টাইপের বাসা যেখানে একটি শোবার ঘর, লিভিং কাম ডাইনিং রুম, এক বাথ আর কিচেন থাকে।
একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে এখানে থাকতে পারে। যেহেতু কাজের জন্য সারাদিন নারীটি বাইরে থাকে তাই একা ঘরে শিশুটিকে রাখা যায় না। সেক্ষেত্রে কান্ট্রি সাইডে বসবাস করা মায়ের কাছে অর্থাৎ শিশুটিকে তার নানির কাছে রাখা হয়। সে বেড়ে উঠে একটি অপারিবারিক পরিবেশে। কোনো কোনো শিশু বড় হয়ে তার পিতার মুখ মনে করতে পারেনা। আবার পেটে থাকতেই যে শিশুর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেলো সে তার পিতাকে চেনেই না।
Advertisement
এখানে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মতই একটি শিশুর জন্য পরিবারের চেয়ে বেশি দায়বদ্ধতা থাকে রাষ্ট্রের। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই একটি শিশুর পিতা থাকে না তাই স্কুলে ভর্তির সময় শিশুটির মা তার বয়ফ্রেন্ডের নাম লিখতে পারে। “বয়ফ্রেন্ড” বা “গার্লফ্রেন্ড” এখানে একটি স্বীকৃত সম্পর্ক। একজন নারীর চারটি সন্তান আলাদা বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে থাকতে পারে। এই শিশুগুলো নিজে নিজে নানির কাছে বড় হয় কিংবা মায়ের কাছে চারজনই মিলেমিশে ভাইবোন হয়ে থাকে।
আমার এক কলিগের সাথে একবার তার পরিবার নিয়ে কথা হচ্ছিলো। ওর নাম জোয়ানা। তো, জোয়ানা বলছিলো, ওরা চার ভাইবোন কিন্তু প্রত্যেকেরই বাবা আলাদা। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, জোয়ানা, “তোমার বাবার সাথে কি তোমার প্রায়ই দেখা হয়?”সে উত্তরে জানিয়েছিলো, জোয়ানা তার বাবাকে কখনোই দেখেনি। শুধু তার মায়ের সাথে ফটোতে দেখেছে। আমি বললাম, “তাহলে তুমি তাকে খুঁজে বের করতে পারো!” জোয়ানা বললো, “কি এসে যায়! সেতো আমাকে খুঁজে বের করেনি কখনো!” আমি তার কৃষ্ণ মুখ বেদনায় কৃষ্ণতর হতে দেখেছিলাম। আমি জানি, ওদের কাছে এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু তবুও সেই মুহূর্তে আমি আমার দীর্ঘশ্বাস রুধতে পারলাম না।
এখানে আমাদের স্কিনটোনের মানুষ দেখলেই ওরা জিজ্ঞেস করে, “তোমারতো স্বামী আছে তাইনা?” এরপর হ্যাঁ বোধক উত্তর শুনলে বলে “তোমরা বাংলাদেশিরা কত সৌভাগ্যবান যে তোমাদের বিয়ে হয়, স্বামী কিংবা স্ত্রী থাকে। পারিবারিক বন্ধন থাকে!” হ্যাঁ আমাদের পারিবারিক বন্ধন থাকে। কিন্তু সেই বন্ধন অনেক সময় এতটাই শক্ত হয় যে গলার উপর লোহার শেকলের মত বিঁধে থাকে। আমাদের দেশে ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে আসে তার বাড়ি। এখানেই মেয়েটি তার নিজ পরিবার গড়ে তোলে। কিন্তু সেই এক্সটেন্ডেড পরিবার গড়ে তোলাটা মেয়েটির জন্য সবসময় এত সহজ হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশে একটি মেয়ের আসলে শুধু তার স্বামীর সাথে বিয়ে হয় না। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় পরিবারের সবার সাথে। সকলের মন জুগিয়ে চলতে হয়।
মেয়েটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশ থেকে এসে নতুন একটা পারিবারিক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। এক্সটেন্ডেড পরিবারের সহযোগিতা পেলে এই মানিয়ে নেওয়াটা কারো ক্ষেত্রে মসৃণ হয় আর সেটা না পেলে কারো জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। শুধু মেয়েটিই যে এই যাতনা ভোগ করে বিষয় তা না। সদ্য অন্য এক ভুবনে পা দেওয়া স্বামীটিও প্রতিদিন হেঁটে চলে এক দুঃসহ পথে। যুথবদ্ধ পরিবার প্রথায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নব্য স্বামী হয়ে উঠা পুরুষটিকে নিয়ে বউ আর মায়ের মধ্যে চলে এক ধরনের টানা পোড়েন। মা নিজের ছেলের স্বত্ব ছেড়ে দিতে পারে না। আবার বউটিও চায় স্বামী তার পাশে থাকুক। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে বহু পরিবার নষ্ট হয়ে যায়। ভেঙ্গে যায় সাধের সংসার। কেউ কেউ সেলফ হার্মের মত ভয়াবহ পথও বেছে নেয়।
আবহমান কাল ধরে চলতে থাকা আমাদের এই যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় পারিবারিক অঃন্তকলহ সবসময়ই ছিল। কিন্তু ইদানীং সময়ে একে প্রকট আকার ধারণ করতে দেখা যায়। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের অনেক বিবর্তন, পরিবর্তন, পরিমার্জন এসেছে। এখন এই বিষয়টাকেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা জরুরি।
যেমন আমি সাউদার্ন আফ্রিকার পরিবারে যেমন বন্ধনহীন বন্ধনের এক চিত্র দেখেছি, তেমনি তাদের পরিবারে দেখেছি স্বাধীনতা,ফ্রিডম অব চয়েজ। স্বামী/স্ত্রী কিংবা গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড ছাড়া তৃতীয় কোন পক্ষ ওদের মাঝে থাকেনা। ফলত পারিবারিক বউ-শ্বাশুড়ির যে কলহ সেটা এখানে অনুপস্থিত। তারা তাদের নিজেদের জীবন নিজেরা উপভোগ করে। অন্য কারো আরোপিত জীবন এরা কাটায় না। যতদিন ভালো লাগে, যতদিন পারস্পরিক ভালোবাসা আর সম্মানবোধ থাকে ততদিন তারা একসাথে থাকে। সম্পর্ক যদি আর ওয়ার্ক না করে তখন তারা জোর করে একসাথে থাকেনা। কিন্তু সব মন্দ ভালো জেনে বুঝেও আমরা আলাদা এক জাতিস্বত্ত্বা, আমরা বাঙালি। মন্দ নাকি ভালো জানিনা, আমরা আমাদের পরিবারের জন্য বিশেষ করে সন্তানের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে দিতে পারি। এক মায়ের কথা শুনছিলাম, নভেম্বরের শেষদিক। রাতে বেশ ঠান্ডা পরে যায়। সিজন চেইঞ্জের জন্য চার বছর বয়সী কন্যার জ্বর এসেছে। সারাদিন মোটামুটি হলেও রাতে আকাশ পাতাল জ্বর। নাপা সিরাপে কাজ হচ্ছিলো না, এমনকি সাপোজিটরি দেওয়ার পরও গা উনুনের মত গরম। উত্তাপ কমানোর জন্য মা বাথটাবে পানি ভর্তি করে মেয়েকে কোলে নিয়ে নভেম্বরের শীতে পানিতে ডুবে রইলো।
আরেকবার আমার মেয়ের স্কুলে দেখা হয়েছিলো এক বাবার সাথে। স্কুলে নাচের অনুষ্ঠান। আমি গিয়েছি টিচারের কাছে কস্টিউমের ফর্দ আনতে । সব বাচ্চার মা এসেছে শুধু একটি মেয়ের এসেছে বাবা। বাবাটিকে হতবিহ্বল দেখাচ্ছিলো। চুড়ি, টিপ, জরি পারের লাল শাড়ি পেটিকোট, মাপ মত ব্লাউজ, পায়ের আলতা। বাবাটি ফর্দ পড়ে আর তার কপাল আরো একটু কোঁচকায়। আমি একটু উৎসুক হয়ে বললাম, আপনি সব কিছু না চিনলেও ভাবিকে ফর্দটা দিলে তিনি এগুলো কিনে নিবেন। এর উত্তরে বাবাটি জানালো, উনার স্ত্রী মারা গেছে বছর খানেক আগে।
মেয়ের স্কুল থেকে ধরে সব দেখাশুনা তিনি নিজেই করেন। আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। আমি আমার ফোন নাম্বার দিয়ে কোন কিছু জানার দরকার হলে আমাকে কল দিতে বললাম। সেই বাবাটি আমাকে কল দেয়নি। হয়তো নিউ মার্কেটে গিয়ে আলতার দোকান থেকে আলতা কিনেছে, শাড়ির দোকানে গিয়ে খুঁজে বের করেছে জরিপাড় লাল শাড়ি। দোকানি না জানতে চাইলেও হয়তো হড়বড় করে বলেছে, “আমার মেয়ের স্কুলে নাচের অনুষ্ঠান। এগুলো কিনতে হবে! কি যে যন্ত্রণায় পড়লাম!” কিন্তু আমি নিশ্চিত, উনার মুখে কোনো যন্ত্রণার ছাপ ছিল না, বরং ছিল ঝিকমিকে আনন্দ!
এই সব কিছুকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত টিকে আছে বাংলাদেশের পরিবার। তবুও আমরা আমাদের পরিবারকে নিঃশেষে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা শুদ্ধ হলে শুদ্ধ, ভুল হলে ভুল!
লেখক : কবি, লেখক।
এইচআর/এএসএম