যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যে কঠোর শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন এক ঝড় তুলেছেন। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল থেকে চালু হওয়া এই শুল্ক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, তবে বিভিন্ন সূচকে এরই মধ্যে উদ্বেগজনক ইঙ্গিত মিলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্কের আসল প্রভাব অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়তে আরও কিছুটা সময় লাগবে, তবে প্রথম দিকের তথ্য থেকেই ভবিষ্যৎ বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।
Advertisement
ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। ডালাস ফেডারেল রিজার্ভের এক জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। একইসঙ্গে ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশটির জিডিপি বার্ষিক হারে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে বিপুল পরিমাণ চীনা পণ্য আমদানি করে গুদামে মজুত করার চেষ্টা।
জাহাজ চলাচল ও আমদানি তথ্য যা বলছে
Advertisement
কোভিড-১৯ মহামারির সময় অর্থনৈতিক প্রবণতা বোঝার জন্য যেমন রেস্টুরেন্ট বুকিং, চলাচলের তথ্য ও সিনেমা টিকিট বিক্রির মতো নতুন সূচকের দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল, তেমনি এবারও বিশ্লেষকরা শুল্কের প্রভাব পরিমাপ করতে সময়োপযোগী তথ্য বিশ্লেষণ করছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচলের তথ্য। কারণ, প্রতিটি পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্র পথে যাত্রার সময় থেকেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাদের অবস্থান ও বহনকৃত পণ্যের তালিকা সম্প্রচার করে থাকে।
২৫ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহে চীনা পণ্য বহনকারী ১০টি কনটেইনার জাহাজ প্রায় ৫৫৫,০০০ টন পণ্য নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস ও লং বিচ বন্দরে পৌঁছায়। এই পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে প্রায় সমান। তবে যেহেতু চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছাতে জাহাজের সময় লাগে দুই সপ্তাহ থেকে ৪০ দিন, তাই ওইসব জাহাজ শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই যাত্রা করেছিল। অর্থাৎ, এই ডেটা এখনো আসল প্রভাব পুরোপুরি প্রকাশ করছে না।
আশঙ্কাজনক সংকেত
তবে আরও কিছু সূচক শঙ্কা বাড়াচ্ছে। ডেটা প্রতিষ্ঠান ভিজন জানায়, ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া সপ্তাহে চীন-যুক্তরাষ্ট্র রুটে নতুন বুকিং ৪৫ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে ‘ব্ল্যাংক সেলিংয়ের’ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। যার অর্থ, জাহাজগুলো নির্ধারিত গন্তব্য বাদ দিয়ে চলেছে কিংবা এই রুটে কম জাহাজ চালানো হয়েছে।
Advertisement
লজিস্টিকস কোম্পানি ফ্রেইটোস জানায়, গত এক মাসে সাংহাই থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস রুটে প্রতি কনটেইনার পরিবহনের খরচ প্রায় ১ হাজার ডলার কমেছে। এর অর্থ আমদানিকারকরা এখন চীন থেকে আমদানি এড়িয়ে চলছেন। বিপরীতে, ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের খরচ প্রায় একই পরিমাণ বেড়েছে। বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে, ব্যবসায়ীরা বিকল্প উৎস খুঁজছেন।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আসতে দেরি হবে
বাণিজ্যিক ঝাঁকুনির প্রভাব পুরোপুরি অর্থনীতিতে পৌঁছাতে সময় লাগে। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে মজুত করা পণ্যের ওপর নির্ভর করছে। বন্দরের আশপাশে অবস্থিত বন্ডেড ওয়্যারহাউজ বা শুল্কমুক্ত গুদামের চাহিদা বেড়েছে, যেখানে পণ্য রেখে শুল্ক ছাড়াই সংরক্ষণ করা যায় যতক্ষণ না তা বাজারে ছাড়া হয়।
অনেক প্রতিষ্ঠান আবার পণ্যের দাম বাড়ায়নি, যদিও শুল্কের কারণে তা বাড়ানো উচিত ছিল। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগেই স্বাক্ষরিত চুক্তি রয়েছে অথবা তারা ভোক্তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে দাম বাড়াচ্ছে না, এই আশায় যে ট্রাম্প হঠাৎ করেই নিজের মত বদলাতে পারেন।
এছাড়া, অন্য এশীয় দেশগুলোর ওপর আরোপিত কঠিন শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে, যা আমদানিকারকদের উৎপাদন স্থান পরিবর্তনের সময় দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য আরও বেশি আইফোন চীনের বদলে ভারতে তৈরি করবে।
রাজনৈতিক প্রভাব কতটা?
এই অর্থনৈতিক ক্ষতির রাজনৈতিক প্রভাব কী বা কেমন হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক ডেভিড অটর ও তার সহকর্মীদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যেসব এলাকা তার শুল্ক নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকেছে। অর্থাৎ ভোটাররা অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে জেনেও চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক অবস্থান এই নীতিকে সমর্থন করেছে।
সবশেষে বলা যায়, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কোনো বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি না হলেও, সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবণতা বলছে- একটি ‘স্ব-সৃষ্ট’ ঝড় আসতে চলেছে। আবার কোম্পানিগুলোর গুদাম ফাঁকা হতে শুরু করলে, নতুন আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে উঠলে ও সরবরাহ শৃঙ্খলায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সত্যিকার প্রভাব দৃশ্যমান হবে।
এসএএইচ