রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ছাত্র সংসদ না থাকলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয় ছাত্র সংসদ ফি। গত ১৬ বছরে এ খাতে শিক্ষার্থীদের থেকে অন্তত ৫৬ লাখ টাকা ফি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও ফি জমাদানের রসিদ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও ছাত্র সংসদের অস্তিত্ব নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা জানেন না তাদের দেওয়া এই টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষও। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মাঝে।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক শাখা সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিতে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ছাত্র সংসদ বাবদ ২০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। স্নাতকোত্তর ভর্তির সময় নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকা। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ২০ হাজার ও স্নাতকোত্তরে ১৬ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। হিসেব অনুযায়ী এই সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫৬ লাখ টাকা ফি আদায় করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জনতা ব্যাংকের লালবাগ শাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নম্বরে এ টাকা জমা হয়।
জানা যায়, ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের কোনো বিধান রাখা হয়নি। যার কারণে নির্বাচন করতে হলে প্রথমে ছাত্র সংসদ আইনের খসড়া অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পাশ করে তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে। বিধানটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংযুক্ত হলে তারপরেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন যাবে।
ছাত্র সংসদ খাতে নিয়মিত টাকা জমা হলেও এ টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে জানেন না শিক্ষার্থীরা। এমনকি কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি কর্তাব্যক্তিরাও। শুধু বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি ছাত্র সংসদের নামে বিভিন্ন ফি নেওয়া হচ্ছে। অথচ ছাত্র সংসদের কোনো কার্যক্রম আমরা দেখিনি। আমরা জানি না আমাদের টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে। এই টাকা আমাদের অধিকার ছিল, আমাদের কল্যাণে খরচ হওয়ার কথা ছিল।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত নেওয়া ছাত্র সংসদের ফি কোথায় ব্যয় হয়েছে আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। কেউ যদি এই টাকা আত্মসাৎ করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এর জবাবদিহি করতে হবে, আর যেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন প্রতারণা না হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয়ক এস এম আশিক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার পর প্রশাসন আমাদেরকে জানিয়েছে যে, এখন থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাবদ যে টাকা নেওয়া হয় তা আলাদা একটি অ্যাকাউন্ট এ জমা করা হবে। এর আগে যে টাকা নেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে তারা জানেন না।
তিনি আরও বলেন, আগের টাকার সুরাহা চাইলে তারা আশ্বস্ত করেছে পরবর্তীতে এটি সমন্বয়ের চেষ্টা করবে। আমাদের কথা স্পষ্ট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন দুর্নীতির জায়গা হবে না। সবধরনের দুর্নীতি রুখে দিতে আমরা প্রস্তুত।
Advertisement
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শামসুর রহমান সুমন জাগো নিউজকে বলেন, দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আমরা উপাচার্যের কাছে দাবি করেছি। আমরা ঈদুল আজহার আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে ছাত্র সংসদ বাবদ জমা হওয়া টাকা কোথায় ব্যবহার হয়েছে জানতে চাইলে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি।
ট্রেজারার দফতরের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাজহারুল আনোয়ার জাগো নিউজকে, বিভিন্ন খাতে শিক্ষার্থীদের থেকে যে টাকা নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ছাত্র সংসদ ফিও ছিল। এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ব্যয় করা হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের আবাসিক হলের জন্য যে টাকা নেওয়া হয়েছিল সেই টাকা হলের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। আর সেইসময় ছাত্র সংসদ বিষয়টি নিয়ে কেউ দাবি তোলেনি। তাই আলাদা করার প্রয়োজনবোধ করেনি। ছাত্র সংসদের টাকা কেন আলাদা করা হয়নি সেটা বলা মুশকিল। বিগত প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দফতরের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিগত প্রশাসনের সময় ছাত্র সংসদের নামে যে টাকা নেওয়া হয়েছিল সেটা রাজস্ব খাতে জমা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা হয়ত অন্য কোনো খাতে ব্যয় করেছে। এখন সেটার কোনো সুযোগ থাকছে না কারণ ছাত্র সংসদের জন্য আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে সেখানেই ছাত্রদের টাকা জমা হবে। বর্তমান প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সচেতন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এর আগে যত প্রশাসন এসেছে তারা ছাত্র সংসদের নামে টাকা নিয়েছে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে জমাও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি চায় তাহলে অর্থ কমিটি সিন্ডিকেটে পাশ করে শিক্ষার্থীদের টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে দিতেই পারেন। কারণ ৫৫-৬০ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছুই না। তাছাড়া যখন টাকা খরচ করা হয়েছিল তখন তো সেখানে উল্লেখ ছিল না যে এটা ছাত্র সংসদের টাকা। তাই সেই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টেই জমা আছে। উপাচার্য চাইলে ছাত্র সংসদের টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্র সংসদ আইন পাশের জন্য দরখাস্ত দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ছাত্র সংসদ গঠনের কাজ দ্রুতই সম্পন্ন হবে।
আইন ছাড়া কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছাত্র সংসদ বাবদ ফি আদায় করা হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে কীভাবে এ ফি আদায় করা হয়েছে এবং কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তির পর ছাত্র সংসদের জন্য আমরা একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলব। সেখানে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ছাত্র সংসদ ফি জমা থাকবে।
ফারহান সাদিক সাজু/এমএন/জিকেএস