সাহসী এক অদম্য নারী উদ্যোক্তা আম্বিয়া খাতুন লাকী। গরুর খামার গড়ে বদলেছেন নিজের ভাগ্য। অন্যদের জুগিয়েছেন প্রেরণা। লাকীর সফলতা দেখে একই গ্রামে আরও ৮টি গরুর খামার গড়ে উঠেছে। সবাই পেয়েছেন সফলতা। বদলে গেছে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর চিত্র। লাকীর এমন উদ্যোগে আলোচিত হয়েছেন দেশজুড়ে। পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কার। একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে।
Advertisement
সফলতার এই গল্পটি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বাদপুকুরিয়া গ্রামের মৃত গোলাম রসুল কাঙালের মেয়ে আম্বিয়া খাতুন লাকীর।
জানা গেছে, আম্বিয়া খাতুন লাকীর স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। এরপর থেকেই তিনি বাবার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাবার দেওয়া ১ বিঘা জমিতে তিনি ২০১৭ সালে গড়ে তোলেন গরুর একটি ছোট্ট খামার। ৪টি ফ্রিজিয়ান গাভি দিয়ে খামার শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন দু’হাত ভরা সফলতা।
আরও পড়ুন বিক্রি হলেই গোয়ালঘরের দরজা কেটে বের করা হবে ৪০ মণের সম্রাটকে এক গরু থেকে শত গরুর মালিক আমিরুল কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রতীক গরুস্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আম্বিয়া খাতুন লাকী। বর্তমানে লাকীর খামারের পরিধি আরও বিস্তৃত। বড় চারটি শেডে মোট ৬৫টি গরু রয়েছে লাকীর খামারে। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত জাতের ২০টি ফ্রিজিয়ান গাভি, ১৫টি বাছুর।
Advertisement
এছাড়া আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে লাকীর খামারে শুরু হয়েছে গরুর বিশেষ পরিচর্যা। কোরবানির জন্য বাছাই করা গরুগুলোকে দেওয়া হচ্ছে ভিন্ন খাবার। খড়/বিচালি, ঘাস, গ্যামা, নেপিয়ার, পাকচোন, গম, খুদ, ধানের কুড়া খাওয়ানো হয়। এসব গোখাদ্য প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করেন তিনি, যা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
এছাড়া নিত্যদিন গরুর পরিচর্যা, গোসল ও খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য ৫ জন কর্মচারী রেখেছেন লাকী। মাসিক বেতনে কর্মরত ৫ জন সার্বক্ষণিক খামারের দেখাশোনা ও গরুর পরিচর্যা করেন। এছাড়া মাঠ থেকে ঘাস কাটা, ঘাস লাগানো, ঘাসের জমির পরিচর্যার জন্যও রয়েছে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক কর্মচারী। প্রতি মাসে গড়ে ১০ জন খামারে কাজ করে থাকেন। এতে গ্রামের অন্তত ১০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এই খামারে।
খামারের কর্মচারী আব্দুল আলিম জানান, প্রতিদিন গরুর খাবার বাবদ ১২-১৩ হাজার টাকা লাগে। নিয়মিত গরুর পরিচর্যা ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। খামারে কর্মরত ৫ জন কর্মচারীর পরিবারের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হয়েছে।
আব্দুল আলিম জাগো নিউজকে বলেন, লাকী আপার খামারে আমি ছাড়াও আরও চারজন কাজ করেন। আমরা সবাই এই গ্রামের মানুষ। খামারে কাজ করি। মাস শেষে বেতন পাই। বেতনের টাকায় আমাদের সংসার খুব ভালোভাবে চলে। গ্রামের অনেকেই এখন খামার করতে আগ্রহী হচ্ছে।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাগান্না ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামে বসতবাড়ির পাশেই বিশাল জায়গাজুড়ে এক গরুর খামার। খামারের পাশেই বিশালাকৃতির বিচালীর গাদা/পালা। আপন মনে কাজ করছেন খামারের কয়েকজন কর্মচারী। আর খামারের সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে কি না, তা ঘুরে ঘুরে দেখছেন আম্বিয়া খাতুন লাকী। নিঃসন্তান লাকীর সংসার বলতে মা, একমাত্র ভাই, চার বোন, আর ভাগিনা-ভাতিজা। ভাইয়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকার সুবাদে ভাইয়ের সন্তানেরাই লাকীর ধ্যানজ্ঞান।
তবে লাকীর ভাষ্য, খামারের গরু ছাড়াও বাড়িতে তিনি হাঁস-মুরগি, ছাগল পালন করেন। নিজের পোষা গরুর দুধ দিয়ে নিজেই বাড়িতে তৈরি করেন দধি, মিষ্টি, ছানা ইত্যাদি। গবাদিপশুর প্রতি লাকীর টান অনেক। তিনি মনে করেন, এসবই এখন তার সংসার। অতি আপন।
আম্বিয়া খাতুন লাকী বলেন, এক সময় ইউটিউবে খামারের ভিডিও দেখতাম। ভিডিওতে বিভিন্ন খামারের গল্প দেখতাম। মানুষের সফলতার গল্প দেখতাম। এক পর্যায়ে গরুর খামার করার দৃঢ় ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসে। আমিও শুরু করি গরুর খামার।
লাকী বলেন, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে আমি ৪টি ফ্রিজিয়ান গাভি দিয়ে খামার শুরু করি। এরপর সেই গাভি থেকে অনেকগুলো বাছুর পাই। এরপর আর খামার নিয়ে ভাবতে হয়নি। এখন নিয়মিত গরু কিনি, বিক্রি করি। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভালো জাতের গরু কিনে সংগ্রহ করি। তিন থেকে চার মাস লালন-পালনের পর গরু বিক্রি করে দিই। এতে খামারের খরচ মেটানো সহজ হয়।
জানা গেছে, অন্যকে স্বাবলম্বী করার প্রবল ইচ্ছা থেকে আম্বিয়া খাতুন লাকী বাদপুকুরিয়া উত্তরপাড়া গাভি গরু প্রতিপালন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওই সমিতির প্রত্যেক সদস্য প্রতিমাসে ১০০০ টাকা জমা দেন। সমিতির মূলধন এরইমধ্যে ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। লাকীর নিজের খামার, অন্যদের খামার গড়তে সহায়তা প্রদান ও নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগে বাদপুকুরিয়া গ্রামের চিত্রই যেন পাল্টে গেছে। এসব কারণে এলাকার সবশ্রেণির মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় আম্বিয়া খাতুন লাকী।
গরুর খামার গড়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেই লাকীর। তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে স্বল্পমেয়াদি ছোট ছোট প্রশিক্ষণ তিনি পেয়েছেন। তবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা এক হয় না। তাইতো, গরুর খামার ও গরু লালন পালনে লাকীর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয় স্থানীয়রা। অন্যদের কোনো সমস্যা হলে, ছুটে আসেন লাকীর কাছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের অন্যতম উদীয়মান উদ্যোক্তা নির্বাচিত হন আম্বিয়া খাতুন লাকী। একাধিকবার পেয়েছেন জয়িতা পুরস্কার। বিশ্বব্যাংক থেকে পেয়েছেন আর্থিক অনুদান।
আম্বিয়া খাতুন লাকী জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা নিয়মিত খামারের খোঁজখবর নেন। খামারের জন্য নিজস্ব চিকিৎসক আছেন। তবে তিনি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের চিকিৎসক ডা. তারেক মুসার অবদানের কথা স্বীকার করেন অবলীলায়।
বাদপুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, লাকী আপা একজন সৎ মানুষ। তিনি মানুষের উপকারে নিজের উপার্জিত অর্থ দেদারছে ব্যয় করেন। লাকী আপার খামারের সফলতা দেখে অনেকেই খামার করেছে।
অদম্য নারী উদ্যোক্তা লাকী জাগো নিউজকে বলেন, আমি চাই দেশের সকল নারী স্বাবলম্বী হোক। প্রতিটি পরিবারে সচ্ছলতা আসুক। আমার খামার দেখে গ্রামে আরও ৮টি খামার গড়ে উঠেছে। সেই ৮টি পরিবার এখন সচ্ছল। পরিশ্রম, সততা ও ধৈর্য থাকলে সফলতা আসবেই। চাকরির পেছনে না ছুটে চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করার মানসিকতা থাকতে হবে। দেশের তরুণ-যুব সমাজ ও গ্রামের মা-বোনেরা চাইলেই খামার গড়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, আম্বিয়া আক্তার লাকী আমাদের ডেইরি খামারি আইকন। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে আমরা তাকে ডেলিগেট হিসেবেও ইনভাইট করে থাকি। আম্বিয়া আক্তার লাকীর সংগ্রামী জীবন। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে যতটুকু করা যায়, ততটুকু করার চেষ্টা করেছি। তবে তার সফলতার জন্য পুরো ক্রেডিট তার নিজেরই। অনেকেই লাকীর খামার দেখে খামার গড়েছেন। সফল উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন একাধিকবার।
এফএ/জিকেএস