ফিচার

সেবা-শুশ্রূষার নেপথ্যে যারা

সেবা-শুশ্রূষার নেপথ্যে যারা

সানজানা রহমান যুথী

Advertisement

প্রতিটি হাসপাতালের করিডোর, ওয়ার্ড কিংবা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যদি আপনি খানিকক্ষণ দাঁড়ান, দেখতে পাবেন কিছু মানুষ সবসময় ব্যস্ত-একটু আগে ইনজেকশন দিয়েছেন, এখন খাবার দিচ্ছেন, তার মাঝেই আরেক রোগীর ডাকে ছুটে যাচ্ছেন। এদের মুখে ক্লান্তির রেখা, তবু চোখে-মুখে মমতা। এরা হলেন নার্স। আমাদের সেবার নিঃশব্দ যোদ্ধারা।

তাই নার্সদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে প্রতি বছর ১২ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক নার্স দিবস, যা আধুনিক নার্সিংয়ের জননী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিনের দিন। এই দিনটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক গভীর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। তাদের প্রতি, যারা আমাদের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তগুলোতে পাশে থাকেন। তারা শুধুই পেশাজীবী নন, তারা আমাদের সাহসের মূর্ত প্রতীক।

প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নার্স দিবসকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। এবারের ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘আমাদের নার্স, আমাদের ভবিষ্যৎ। সেবাই অর্থনীতর শক্তি’ এই প্রতিপাদ্যটি নার্সদের অবদানকে কেবল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মূল্যায়নের আহ্বান জানায়। কারণ, নার্সদের সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটি জাতির সুস্থতা, উৎপাদনশীলতা এবং ভবিষ্যৎ গঠনের ভিত্তি।

Advertisement

নার্সিং:পেশার বাইরেও এক ভালোবাসা

নার্স হওয়া মানে শুধু চাকরি নয়; এটি এক ধরনের মানবিক দায়িত্ব। শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর মানসিক সাপোর্ট দেওয়া, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, প্রয়োজনে সাহস জোগানো-এসবই একজন নার্সের নিত্যকার কাজ। বিশেষ করে যে মুহূর্তে রোগীর পাশে তার প্রিয়জন নেই, সেখানেই নার্স হয়ে ওঠেন মা, বোন কিংবা বন্ধু।

নার্স মানেই শুধু ‘সিস্টার’ নন

আমাদের দেশে এখনো নার্স শব্দটি শুনলে অনেকের মনেই আসে একজন নারী যিনি চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু আধুনিক নার্সিং পেশা অনেক পরিসরজুড়ে বিস্তৃত। নার্সরা শুধু ইনজেকশন দেওয়া বা ওষুধ খাওয়ানোই নয়, রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকের সহায়ক হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন, শিশু যত্ন, প্রবীণদের সেবা ইত্যাদিতে নার্সদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

মহামারির দিনগুলো: নার্স মানেই সম্মুখযোদ্ধা

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি যখন বিশ্বজুড়ে মৃত্যু ও আতঙ্কের ছায়া ফেলেছিল, তখন সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন নার্সরাই। তাদের অনেকেই টানা মাসের পর মাস পরিবার থেকে দূরে থাকেন, রোগীর সেবায় নিজেদের সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেন। সেই কঠিন সময়ে তারা পিপিই পরে ঘামে ভিজে, চোখে-মুখে ক্লান্তি নিয়ে দিন পার করেছেন কিন্তু তারা পিছু হটেননি। ঢাকার একটি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রাশেদা পারভীন বলেন, ‘করোনার সময় নিজের শিশুকে এক বছর পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখিনি। তখন মনে হতো, আমি শুধু নার্স নই, আমি যেন একজন সৈনিকযার দায়িত্ব জীবন বাঁচানো।’

বাংলাদেশে নার্সদের বাস্তবতা

বাংলাদেশে নার্সদের অবদান অপরিসীম হলেও, পেশাগতভাবে তারা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা, স্বীকৃতি এবং সমাজের সম্মান এখনো অনেকখানিই সীমিত। অনেক সময় রোগীর স্বজনদের দুর্ব্যবহার কিংবা কর্মস্থলের বৈষম্যেরও শিকার হতে হয়।

Advertisement

অথচ, একজন দক্ষ নার্স মানেই একটি হাসপাতালের প্রাণ। চিকিৎসক যেমন রোগ নির্ণয় করেন, নার্স সেই চিকিৎসাকে বাস্তবে রূপ দেন। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটাই একজন নার্সের মমতা, দক্ষতা ও সহানুভূতির ওপর অনেকখানি নির্ভর করে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নার্সিং: একটি সম্মানজনক পথ

বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যখাতে ক্যারিয়ার গড়তে চায়। তবে নার্সিংকে অনেক সময় ‘ডাক্তার না হতে পারার বিকল্প’ হিসেবে দেখা হয়, যা একেবারেই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। নার্সিং একটি পূর্ণাঙ্গ, সম্মানজনক ও আন্তরিক পেশা। উন্নত প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সেবা এবং নিজের মানবিক দিককে বিকশিত করার সুযোগ সবকিছুই নার্সিং পেশায় রয়েছে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নার্সরা উচ্চ বেতনের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও পান। বাংলাদেশেও এই পেশাকে যদি যথাযথভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে নার্সিং হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি গর্বিত পেশা।

একজন নার্স যখন সেবার জন্য এগিয়ে আসেন, তখন তিনি নিজের পরিচয় ভুলে যান তিনি শুধু ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেন আরেক মানুষের পাশে। এই আন্তরিকতা, এই দায়িত্ববোধ এবং এই ভালোবাসার প্রতিদান কখনোই কোনো অর্থমূল্যে মাপা যায় না। আন্তর্জাতিক নার্স দিবস তাই কেবল একটি দিন নয়; এটি একটি উপলক্ষ-সেইসব মানুষের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের, যারা ক্লান্তি ভুলে আমাদের জীবনযুদ্ধে পাশে থাকেন।

আরও পড়ুন

কয়লা শ্রমিকের ঘামে জ্বলে উঠে শহরের বাতি ৯০ দশকের ছেলেমেয়ের স্মৃতিতে আজও সতেজ টমটম গাড়ি

কেএসকে/এমএস