ফিচার

যে প্রাণীর রক্তে প্রাণ রক্ষা পেয়েছে হাজারো মানুষের

আল মাসুম হোসেন

Advertisement

একটি কাঁকড়া! যার এক লিটার রক্তের দাম প্রায় ১৫ লাখ টাকা। একটি দুটি নয়, এর শরীরে রয়েছে ১০টি চোখ। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। এর রক্ত লালের বিপরীতে নীল হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এটি পরিচিত না হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক।

বিশেষ এই কাঁকড়ার নাম হর্সশু ক্র্যাব। এর মোট চারটি প্রজাতি রয়েছে একটি আমেরিকা (লিমুলাস পলিফেমাস) ও বাকিগুলো উত্তরপূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। এটির আকার আকৃতি অনেকটা ট্যাংকের মতো। এটি জীবন্ত জীবাশ্ম অর্থাৎ কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই প্রায় ৪৪৫ মিলিয়ন বছরের বেশি পৃথিবীতে টিকে আছে সেই ডায়নোসরের আগে থেকে। এই টিকে থাকার প্রধান কারণ হলো এদের দেহের গঠন, কথিত আছে ‘এটি যতক্ষণ না ভাঙে ততক্ষণ জোড়া নেয়না।’ এদের মাথায় দুটি বড় চোখ ছাড়াও, শরীরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট চোখ রয়েছে যা বিভিন্ন দিক থেকে আলোর উপস্থিতি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। হর্সশু ক্র্যাবের স্ত্রী প্রজাতি পুরুষ প্রজাতির তুলনায় বড় আকারের হয়। প্রজনন মৌসুমে এরা তীরে এসে প্রায় এক লাখ ডিম পাড়ে।

শুধু তাই নয়, করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে যেখানে সবার নজর ছিল কীভাবে দ্রুত একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়। সেখানে সমুদ্রের এই ছোট্ট প্রাণি মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ভাবছেন তা আবার কীভাবে? আর এই কাঁকড়ার রক্তে এমন কী আছে, যা এত মূল্যবান?

Advertisement

মানুষের রক্তে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য লোহা-ভিত্তিক প্রোটিন হিমোগ্লোবিন ব্যবহৃত হয়, যা রক্তকে লাল রং দেয়। অন্যদিকে, হর্সশু ক্র্যাবের রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে তামা-ভিত্তিক প্রোটিন হেমোসায়ানিন ব্যবহৃত হয়, যা রক্তকে নীল রং প্রদান করে। যার এক লিটারের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে গুনতে হবে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার।

হর্সশু ক্র্যাবের রক্তে আছে লিমুলাস অ্যামেবোসাইট লাইসেট (এলএএল)নামক এক বিশেষ উপাদান যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া (এন্ডোটক্সিন) শনাক্ত করতে পারে। ১৯৭০ সালের দিকে পাইরোজেন টেস্টের পরিবর্তে এই কাকড়ার রক্ত ব্যাবহৃত হয়। করোনার ভ্যাকসিন তৈরি হলেও, সেটি মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার আগে নিশ্চিত হতে হয় যে এতে কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নেই। আর তখন ভ্যাকসিনের প্রতিটি ডোজে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়েছে এর রক্ত। এছাড়া অন্যান্য অনেক ওষুধের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষায় এই রক্তের ব্যবহার হচ্ছে। যার ফলে এই কাঁকড়ার রক্ত অত্যন্ত দামি।

মূলত আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু উপকূলবর্তী অঞ্চলে পাওয়া এই কাঁকড়ার রক্তের চাহিদা ব্যাপক। তবে বাণিজ্যিকভাবে রক্ত সংগ্রহ ও পরিবেশগত কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রাণীটি আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের রক্ত থেকে অনেক ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। তাই এদের সংখ্যা কমে যাওয়া আমাদের সবার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই একে রক্ষা করতে আমরা সবাই বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে পারি যেমন-হর্সশু ক্রাব সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করুন। এরা কেন গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে এদের সংখ্যা কমছে এবং আমরা কীভাবে এদের সাহায্য করতে পারি, সে সম্পর্কে জানুন।

এছাড়া বৈধভাবে সংগ্রহ করুন, হর্সশু ক্রাবের প্রাকৃতিক আবাসস্থল যেমন জোয়ারের জমি, নদীমুখ ইত্যাদি রক্ষা করতে সাহায্য করুন। এই স্থানগুলোতে আবর্জনা ফেলবেন না, গাছ কাটবেন না। হর্সশু ক্রাব রক্ষার জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলোতে সমর্থন জানান। হর্সশু ক্রাবের রক্তের বিকল্প খুঁজতে বিজ্ঞানীরা বিকল্প রাসায়নিকের প্রস্তুতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

আরও পড়ুন কয়লা শ্রমিকের ঘামে জ্বলে উঠে শহরের বাতি  ৯০ দশকের ছেলেমেয়ের স্মৃতিতে আজও সতেজ টমটম গাড়ি 

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম কুবি শাখা

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা, ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম, সাউথ কান্ট্রি রুথ আইল্যান্ড

কেএসকে/জিকেএস