রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি ক্লাস্টারের আধুনিকায়ন ও পণ্যের বহুমুখীকরণে সহায়তা করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। বেনারসি তাঁতশিল্পকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আধুনিক তাঁত মেশিন সরবরাহ এবং ডিজিটাল ডিজাইন পদ্ধতি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ফলে উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ কমেছে এবং উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। তবে বেনারসি তাঁতপণ্য রক্ষায় সহায়তা বৃদ্ধি ও আলাদা পল্লির দাবি তুলেছেন উদ্যোক্তারা।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (৮ মে) মিরপুর বেনারসি ক্লাস্টারে ১০ দিনব্যাপী পণ্য বৈচিত্র্যকরণ প্রশিক্ষণের সমাপনী, পণ্য প্রদর্শনী ও ক্লাস্টার পরিদর্শন অনুষ্ঠানে এসব কথা উঠে আসে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন এসএমই ফাউন্ডেশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা খান। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, বেনারসি শিল্পের উন্নয়নে সব বাধা দূর করতে বর্তমান সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট আবেদন করা হলে সরকার সব ধরনের সহায়তা করবে।
Advertisement
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপানসন মো. মুসফিকুর রহমান বলেন, মিরপুর বেনারসি পল্লির শাড়িকে দেশব্যাপী এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করতে এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এসএমই মেলা, হস্তশিল্প প্রদর্শনী, হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বেনারসি শাড়ির মান বজায় রেখে সুন্দর ব্র্যান্ডিং ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে এর বাজারমূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বেনারসি ক্লাস্টারের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশন যৌথভাবে কাজ করছে। কারিগরদের ব্যবসায়িক মূলধনের সংকট অনেকটাই কমে এসেছে।
আরও পড়ুনদশ বছরের পুরাতন গাড়ি আমদানিযোগ্য করার দাবি বারভিডারমিরপুর বেনারসি ক্লাস্টার বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও সুপরিচিত হস্তশিল্পভিত্তিক শিল্প ক্লাস্টার, যা ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় অবস্থিত। ক্লাস্টারটি মূলত বেনারসি শাড়ির উৎপাদন, নকশা ও বিপণনের জন্য বিখ্যাত। বেনারসি শাড়ি একটি গৌরবময় ও নান্দনিক শিল্পপণ্য, যা দেশে ও বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত। মিরপুর বেনারসি শিল্পের সূচনা মূলত ১৯৪৭ সালের পরপরই ঘটে, যখন ভারতের বারাণসী (বেনারস) অঞ্চল থেকে কিছু মুসলিম তাঁতি পরিবার এই অঞ্চলে স্থানান্তরিত হন। তারা মিরপুরে বসতি স্থাপন করে বেনারসি তাঁত স্থাপন করেন এবং ধীরে ধীরে এক বৃহৎ শিল্পঘাঁটি গড়ে তোলেন। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫০-২০০ তাঁত মালিক এবং সহস্রাধিক তাঁত শ্রমিক সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
মিরপুর বেনারসি ক্লাস্টারে প্রাধান্য পায় শাড়ি তৈরির কাজ। এখানে বিভিন্ন ধরনের বেনারসি পণ্য যেমন- কাতান বেনারসি, জামদানি বেনারসি, শুঁয়া বেনারসি, ব্রাইডাল বেনারসি শাড়ি, রেশমী ও জারিদার কাজের শাড়ি তৈরি হয়। বর্তমানে এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোক্তারা বেনারসি কাপড় দিয়ে বটুয়া, পার্স, টাই, কটি, পাগড়ি, হিজাব ইত্যাদি আনুষঙ্গিক পণ্যও তৈরি করছেন। ক্লাস্টারটি ঢাকার অন্যতম শ্রমনির্ভর শিল্পকেন্দ্র, যা স্থানীয় নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক নারী ঘরে বসেই এমব্রয়ডারি, কারুকাজ ও সেলাইয়ের কাজের মাধ্যমে আয় করছেন। এই ক্লাস্টার একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
Advertisement
উদ্যোক্তারা জানান, মিরপুর বেনারসি ‘জিআই’ নিবন্ধন পেলেও ঐহিত্যবাহী এই পণ্য হাতছাড়া হবার পথে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এই ধরনের একটি শাড়ি তৈরি করতে ১০ দিন থেকে প্রায় এক মাস সময় প্রয়োজন। কিন্তু ভারত থেকে বেনারসি শাড়ির নামে অত্যন্ত নিম্নমানের (পলিস্টার সুতায় উৎপন্ন) পণ্য অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসে। তারা বেনারসি শাড়ির নামে এই পণ্য অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি করে, যে কারণে তার মূল্যও অনেক কম থাকে।
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, এই শিল্পকে বাঁচাতে ২০০৩ সালে ভাষানটেক বেনারসি পল্লির প্লট বরাদ্দের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় ভাষানটেক বেনারসি পল্লিতে প্লট বরাদ্দ পেলে দ্রুত ব্যবসার প্রসার ও উন্নয়ন করা সম্ভব বলে দাবি বেনারসি উদ্যোক্তাদের।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, দেশে ৭৮ লাখের বেশি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশের বেশি। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ এসএমই খাতে। এই খাতে প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি জনবল কর্মরত আছে। অধিক জনসংখ্যা এবং সীমিত সম্পদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কেএসআর/জেআইএম