আন্তর্জাতিক

ভারতের বিমান হামলা: পাকিস্তানের পাল্টা অভিযান কি অনিবার্য?

ভারতের বিমান হামলা: পাকিস্তানের পাল্টা অভিযান কি অনিবার্য?

বুধবার ভোররাতের এক নাটকীয় অভিযানে পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়েছে ভারত। দেশটির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে’ সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোর ওপর এই হামলা চালানো হয়েছে।

Advertisement

তবে পাকিস্তান দাবি করেছে, মাত্র ছয়টি স্থানে হামলা হয়েছে এবং তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এই দাবি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি।

ইসলামাবাদের দাবি, ভারতীয় হামলা ও গুলিবর্ষণে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ২৬ জন নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ১০ জন প্রাণ হারিয়েছে।

আরও পড়ুন>>

Advertisement

পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিশোধ নেওয়ার নির্দেশ শাহবাজ শরিফের পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫ ভারতের ৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানি দাবি নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

এই তীব্র উত্তেজনার সূত্রপাত গত মাসে ভারতের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর চালানো এক প্রাণঘাতী হামলার পর। ওই ঘটনা পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

এই হামলা কি উত্তেজনার নতুন ধাপ?

২০১৬ সালে উরি হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালায়।

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন আধাসামরিক সদস্য নিহত হলে ভারত প্রথমবারের মতো ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের ভেতরে বালাকোটে বিমান হামলা চালায়—যার ফলে পাল্টা হামলা ও আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হয় উভয় দেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার পহেলগামের হামলার জবাবে ভারতের প্রতিক্রিয়া আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বিস্তৃত পরিসরে হয়েছে।

Advertisement

ভারত বলছে, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরজুড়ে নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, যেগুলো লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি), জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান কেন্দ্র ছিল।

সবচেয়ে নিকটবর্তী টার্গেট ছিল শিয়ালকোটের দুটি অবস্থান, যেগুলো সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর সবচেয়ে গভীরভাবে প্রবেশ করা হামলাটি ছিল বাহাওয়ালপুরে জেইএমের কথিত সদর দপ্তরে—যা পাকিস্তানের ১০০ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত। মুজাফফরাবাদে লস্কর-ই-তৈয়বার একটি ক্যাম্পেও হামলার দাবি করা হয়েছে, যা পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী এবং নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে।

পাকিস্তান বলছে, ছয়টি স্থানে হামলা হয়েছে, তবে তারা সন্ত্রাসী ঘাঁটির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে।

ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, এই প্রথম ভারতের হামলার ভৌগোলিক পরিসর আগের চেয়ে বিস্তৃত। আগের বালাকোটের মতো হামলা নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি হতো। এবার ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে পাঞ্জাব প্রদেশে হামলা চালিয়েছে, যা একটি বড় বার্তা বহন করে।

এই সংঘাত কি বড় যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে?

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ আসন্ন এবং এ অবস্থায় কূটনীতি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের সাবেক হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া বলেন, পাকিস্তান নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়া জানাবে। তখন উত্তেজনার পরবর্তী ধাপ সামাল দেওয়াটাই হবে চ্যালেঞ্জ।

লাহোরের বিশ্লেষক ড. ইজাজ হুসেইন বলেন, মুরিদকে ও বাহাওয়ালপুরে ভারতীয় বিমান হামলা প্রত্যাশিতই ছিল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বক্তব্য ও প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে, সীমান্ত অতিক্রম করে পাল্টা হামলা হতে পারে।

তবে তিনি আশঙ্কা করছেন, দুই পক্ষের ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ অবস্থা সীমিত সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানির অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, যেভাবে ভারত বিস্তৃত পরিসরে হামলা চালিয়েছে এবং দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিক্রিয়া না দেখানো কঠিন।

তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তান হয়তো শুধু ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে, যদিও এ নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এই সংকট ২০০২ সালের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক। ২০১৬ বা ২০১৯ সালের উত্তেজনার চেয়েও এখনকার পরিস্থিতি বেশি অস্থিতিশীল।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কি অনিবার্য?

ইসলামাবাদের বিশ্লেষক উমের ফারুক বলেন, পাকিস্তানের সমাজ এখন রাজনৈতিকভাবে ভাঙা। সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান কারাগারে। সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের সমর্থনও আগের মতো নেই। তবে পাঞ্জাবে যদি ভারতবিরোধী জনমত জোরদার হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর ওপর পাল্টা হামলার চাপ তৈরি হবে।

ড. হুসেইন বলেন, এই সংঘাত সেনাবাহিনীর জন্য জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের সুযোগ। এরই মধ্যে মূলধারার গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ভারতের ছয় বা সাতটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে, যদিও এর নিরপেক্ষ সত্যতা যাচাই দরকার। তারপরও এটি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখছে।

সূত্র: বিবিসিকেএএ/