কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মাসে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনার রেশ ধরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরেক দফা অবনতি হলো। পেহেলগামের ঘটনার সময়ই আশঙ্কা করা হয়েছিল আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের ঘটনা বোধ হয় আবারও দেখতে যাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ পাকিস্তানের ২৬ মতান্তরে ৯ স্থানে ভারতের আক্রমণে তা সত্যে পরিণত হলো। থেমে থাকেনি পাকিস্তানও। ভারতেও আঘাত হানে তারা। দুটি ঘটনাতেই হতাহতের সংবাদ হয়েছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কি আমাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে?
Advertisement
ভারত-পাকিস্তানে উত্তেজনা কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও নিরুপদ্রপ থাকার কথা নয়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও মনস্তাত্ত্বিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে নতুন মোড় নিয়েছে,সেখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়াহীন থাকার কথা নয়। অর্থনৈতিকই শুধু নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে মনস্তাত্বিক বিষয়ও। এই ধরনের যুদ্ধপরিস্থিতি কেমন মনস্তাত্বিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এর একটি উদাহরণ মনে পড়লো। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। ১৯৬৫ সালের কথা। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের পূর্বসীমান্ত এলাকায় হওয়ায় আমাদের এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হলো। অজানা আতঙ্ক। কারণ তখনও আমাদের এলাকার মানুষ যুদ্ধ দেখেনি।
স্কুল বন্ধ ঘোষণা হয়ে যেতে পারে, জল্পনা চলছিল। এমন সময় ক্লাসে নোটিশ দেওয়া হলো-সালদানদীতে পাহাড় তৈরি হবে,শিক্ষার্থীরা যেন যোগ দেয়। অর্ধেক স্কুল ফাঁকা হয়ে গেলো। অনেকেই ৫ মাইল দূরের সালদানদী রেলস্টেশনের কাছে ভারতীয় পাহাড়ঘেষা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের গ্রামে গিয়ে কোদাল হাতে মাটি কাটা শুরু করেছে। শত শত সাধারণ মানুষ মাটি কাটায় যোগ দেয়। দর্শনযোগ্য ছোট একটি টিলা তৈরিও হলো সেখানে।
মানুষ আতঙ্ক আর আবেগে দলে দলে যোগ দিয়েছিল পাহাড় তৈরির কাজে। অথচ প্রাকৃতিক উঁচু পাহাড় আর মানুষের গড়া পাহাড় যে সমান নয়, সেই বিষয়টি কেউ খেয়াল করেনি। অন্যদিকে যুদ্ধের খবর জানার জন্য বিত্তবানরা রেডিও কিনতে শুরু করে। মনে আছে, যুদ্ধের সময় আমাদের বড় গ্রামটিতে ২/৩টি রেডিও কেনা হয়েছিল। যুদ্ধের উছিলায় গ্রামে প্রথম রেডিওর প্রবেশ। যার একটি আমাদের। প্রসঙ্গটা টানা হলো আবেগ ও আতঙ্কের কথা প্রকাশের জন্য।
Advertisement
অন্যদিকে ভিন্ন দুটি দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৃতীয় দেশ হিসেবে আমাদের ওপরও যে প্রভাব ফেলতে পারে,তার প্রমাণ পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় আক্রমণ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেলো। বুধবার রাতে তুরস্ক থেকে ঢাকাগামী তার্কিশ এয়ারলাইন্স (টিকে-৭১২)এবং কুয়েত থেকে ঢাকাগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (জে-৯৫৩৩) পাকিস্তানের আকাশপথ দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তবে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪ জানায়, তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি মাঝপথে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ওমানের মাসকট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি প্রায় দেড় ঘণ্টা উড্ডয়নের পর আবারও কুয়েতে ফিরে যায়।শুধু তাই নয় পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহারকারী বাংলাদেশের উড়োজাহাজগুলো তাৎক্ষণিক বিকল্পপথে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করে। এই মুহূর্তে হজ ফ্লাইটসহ অনেক ফ্লাইট এ এই পরিস্থিতিতে পড়েছে। নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশকে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। এটা শুধু পাকিস্তানের আকাশসীমাই নয়,ভারতীয় আকাশসীমাও এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তারা নিজেরাও নিজ দেশে অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল করেছে। অথচ বাংলাদেশ যুদ্ধ পরিস্থিতিসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই নয়।
দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে। আমার ধারণা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ এখন। দুই দেশের উত্তেজনা প্রশমনে বাংলাদেশ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারে। যেটুকু সামরিক হামলা হয়েছে এখানেই যাতে শেষ হয়ে যায়,সেই বারতা নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে যেতে পারে।
এই মুহূর্তে এই অঞ্চলে কিছুটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এমনিতেই ছিল। তবে সেটা যুদ্ধ লাগার মতো এমন মনে হয়নি। কিন্তু পেহেলগামে পর্যটক হত্যার ঘটনার পর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এবং যে মুহূর্তে ভারত সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকে এবং সেদেশের বিরোধী দলগুলো বিজেপি সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে একচ্ছত্র সমর্থন জ্ঞাপন করে,তখন পরিস্থিতি যে জটিলতর হবে তা অনুমান করা যাচ্ছিল। যা ভারত-পাকিস্তানে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে সত্য বলে প্রমাণ হলো। ভারত যখন এ ধরনের ইস্যুতে সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করে তখন যুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধপরিস্থিতি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক আচরণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার বিষয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত বিদ্বেষ বেড়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই মনোভাবকে চাঙ্গা করেছে। এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রচিন্তক কবি ফরহাদ মজহারের একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়-তিনি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীল না। এখানে ধর্মীয় জাতিবাদী গোষ্ঠীগুলোরও কোনো ভূরাজনৈতিক কম্প্রিহেনসিভ দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে কীভাবে বলতে হয়, কোন ভাষায় বলতে হয়, এটা নিয়ে সত্যিকার অর্থে তারা সচেতন না। সব মিলিয়ে আমি চিন্তিত যে, কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। আমাদের আরও অনেক বেশি বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সহনশীলতা ও সংবেদনশীলতা দরকার।'(স্টার বাংলা ২৭ এপ্রিল ২০২৫)।
আমাদের মনে রাখতে হবে,পাকিস্তান কিংবা ভারতের স্বার্থচিন্তার চেয়ে আমাদের নিজ বাংলাদেশের কথা বেশি ভাবতে হবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে,নিরীহ-নিষ্পাপ মানুষ হত্যাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। এটা ভারত কিংবা পাকিস্তান যে কারো দ্বারাই হোক না কেন। এতে কোনো গৌরব নেই। পৃথিবীর কোনো ধর্ম এহেন হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া যেন সেই আলোকেই হয়।
Advertisement
ভারতের হামলার জবাবে জম্মুতে পাকিস্তানের হামলা। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যমে বলা হয়েছে,মসজিদে হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। নারী ও শিশুরা আছে হতাহতের তালিকায়। রয়টার্স এর খবরেও জানা গেছে নারী ও শিশু যেমন হতাহতের তালিকায় আছে তেমনি মসজিদও আক্রান্ত হয়েছে। বাহাওয়ালপুরের সুবহান আল্লাহ মসজিদে হামলায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জয়শ ই মোহাম্মদ এর প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। যেখানে নারী ও পুরুষও আছেন। এক্ষেত্রে ভারতের দাবির কথা উল্লেখ করা যায়,তারা কাশ্মিরে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের জন্য জয়শ ই মোহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহারকে দায়ী করেছিল। একইসঙ্গে তারা এও দাবি করেছে তারা পাকিস্তানের কোনো সামরিক স্থাপনায় হামলা করেনি।
ভারত-পাকিস্তান অবনতিশীল পরিস্থিতি উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব ফেলবে। এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরাম সার্ককে পুনর্জীবিত করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল। সার্ক সৃষ্টিতে যেমন বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, পুনর্জীবিতকরণ চিন্তায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। ভারত পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সেই চিন্তায়ও বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে অতীত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,ভারতে যখন কোনো সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হয়েছে এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বাংলাদেশে। বাবরি মসজিদ ইস্যু কিংবা এমন আরও ঘটনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছিল ।তেমন কোনো ঘটনা যাতে বাংলাদেশে আর না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভারতীয় ঘটনার প্রতিবাদে আমরা যেন আমাদের দেশের সম্পদ কিংবা নাগরিকের ক্ষতি না করি সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি বলে মনে করি। তবে প্রতিবাদ হতে পারে,সেটা অবশ্যই হতে হবে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি না করে।
দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে। আমার ধারণা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ এখন। দুই দেশের উত্তেজনা প্রশমনে বাংলাদেশ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারে। যেটুকু সামরিক হামলা হয়েছে এখানেই যাতে শেষ হয়ে যায়,সেই বারতা নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের কথাও ভাবতে হবে। ভারত-পাকিস্তানের বয়সের সমান তাদের শত্রুতার বয়স। আর এই সমস্যার প্রধান কারণ হচ্ছে কাশ্মীর ইস্যু। ১৯৪৭ এ ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কাশ্মির সমস্যা দেশ দুটিকে বৈরিতার মুখে ঠেলে দেয়। কাশ্মিরের মহারাজ হরি সিং কংগ্রেসের সঙ্গে গরমিলের কারণে ভারতে যেতে চাইছিলেন না আবার হিন্দু পরিবারগুলোর জন্য নিরাপদ নয় এইভেবে পাকিস্তানেও যেতে চাইছিলেন না। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছুটি কাটাতে কাশ্মিরে যেতে চাইলেও হরি সিং তাকে অনুমতি দেননি। এরপর ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধগুলোর পেছনে অবশ্যই কাশ্মির ইস্যুটি প্রধান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত পাকিস্তানে যুদ্ধের শুরুটাও এই কাশ্মীরকে নিয়ে। এবার পহেলগামে পর্যটন হত্যাকে কেন্দ্র করে যে হামলা পাল্টা হামলা হলো, এটাই যেন শেষ যুদ্ধ হয়।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম