জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এখন টিউবয়েল থেকেও পানি উঠছে না। বিগত দিনে পানির সংকট সিটি করপোরেশন এলাকায় দেখা দিলেও এখন পর্যায়ক্রমে জেলা উপজেলাতেও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
Advertisement
পানির সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ ৯ বছর আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু প্লান্ট দুটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় এখন পর্যন্ত একফোটা পানিও তুলতে পারেনি। ফলে প্রয়োজনের অর্ধেক পানিও সরবরাহ করতে পারছে না সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
বরিশাল নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, বাসা-বাড়িতে টিউবয়েল থাকলেও কয়েক বছর থেকে তাতে পানি উঠছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ খাওয়ার পানি, গৃহস্থালি, অজুখানা ও গোসলের পানি চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না। ফলে পানিবিহীন দুর্বিষহ জীবন পার করছেন অনেকে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন- নলকূপ থেকে পানি যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, সংকটে ভুগছেন স্থানীয়রা পৌরসভায় তীব্র পানি সংকট, বাসিন্দাদের হাহাকার ‘এভাবে চলতে থাকলে খালে পরিণত হবে তিস্তা’নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বেলতলা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাবিরুল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকায় চরম পানির সংকট। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এলাকার কোনো চাপকল থেকে পানি ওঠে না। ফলে সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহের গাড়ির জন্য তাকিয়ে থাকতে হয়। সিটি করপোরেশনের গাড়িও ঠিকমতো আসে না।
Advertisement
নগরীর রুপাতলী ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের পাশের এক বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময় এ প্লান্ট চালু না করায় এর অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এই প্লান্ট চালু করতে হলে পুনরায় সবকিছু নতুন করে স্থাপন করতে হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৫ লাখ নগরবাসীর জন্য ৬ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। এর বিপরীতে উৎপাদন করা হচ্ছে মাত্র তিন কোটি লিটার। ফলে নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে কীর্তনখোলা নদীর তীরে বেলতলায় ২০১২ সালে হাজার ১৯ কোটি টাকা এবং রুপাতলীতে ২০১৩ সালে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের জুন মাসে ওই দুটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ওই প্লান্ট দুটির মাধ্যমে ১ কোটি ৬০ লাখ করে ৩ কোটি ২০ লাখ লিটার বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় ৯ বছরেও উৎপাদনে যেতে পারেনি প্লান্ট দুটি। এখান থেকে পানি সরবরাহের জন্য পুরো নগরীজুড়ে পাইপ বিছিয়ে রাখা হলেও আদৌ তা কোনো উপকারে আসেনি নগরবাসীর। বরং নির্মাণের পরপরই কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বেলতলার প্লান্ট।
এদিকে সিটি বাইরে বিভিন্ন উপজেলা ঘুরেও দেখা গেছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। উপজেলার মানুষ এখন পানির চাহিদা মেটাতে নদী খাল আর পুকুরনির্ভর হয়ে পড়েছেন।
উপজেলার বাবুগঞ্জ কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা সৈয়দা রাবেয়া জানান, আগে আমাদের টিউবওয়েলে এক চাপে অনেক পানি উঠতো। এখন পানি ওঠে না বললেই চলে। কয়েক বছর ধরেই পানির এ অবস্থা। এখন হাঁড়ি পাতিল ধোঁয়ার কাজ পুকুরের পানি দিয়েই করতে হয়। এছাড়া ঘরের পুরুষ যারা আছেন তারা পানি সংকটে দীর্ঘদিন ধরে নদীতেই গোসল করছেন।
Advertisement
উজিরপুর উপজেলার বামরাইল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা পারভেজ সিকদার বলেন, এই উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই। সুপেয় পানির উৎস টিউবওয়েলে এখন পানি ওঠে না বললেই চলে। তাছাড়া মিষ্টি পানির অভাবে শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে বলেও তিনি জানান।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান তরফদার বলেন, কয়েক বছর ধরেই দেশে পুকুর ভরাট, নদী-খাল দখলের প্রভাব বেড়েছে। যা পানি সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণেই পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে নদী-খাল শুকিয়ে যাচ্ছে, নিজেরা পানি অপচয় করছি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করছি না, আগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূগর্ভে প্রবেশ করতো, এখন নগরায়ণের ফলে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। এসব বিষয়ে সবার সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নজর রাখা উচিত।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী জাগো নিউজকে জানান, পানির সমস্যা সমাধানে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যার অনুমোদন পেলেই পানির সমস্যা সমাধানে কাজ করা হবে।
এফএ/এএসএম