চুয়াডাঙ্গা সদরে শতাধিক ভুট্টাচাষি ‘নাবা জিরো ৫৫’ জাতের বীজ রোপণ করে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। উপজেলার পদ্মবিলা ও তিতুদহ ইউনিয়নের সুবদিয়া, কোটবাড়ি, পিরোজখালী ও নিমতলা গ্রামের এসব কৃষক ‘নাবা ক্রপ কেয়ার লিমিটেড’ কোম্পানি থেকে এ বীজ সংগ্রহ করেন।
Advertisement
কৃষকদের অভিযোগ, গাছে শিষ না আসায় তারা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জমি চাষ, সার, সেচ ও শ্রম খরচসহ প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করেও আশানুরূপ ভুট্টা ঘরে তুলতে পারেননি অনেকে।
সুবদিয়া গ্রামের কৃষক মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলাম। গাছ হয়েছে ভালোই, কিন্তু শিষ আসেনি। প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করেছি। ফলন তো দূরের কথা, পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করার মতো কিছু পাইনি।
একই গ্রামের মো. আব্দার রহমান বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে বপন করেছিলাম, ক্ষেতের সব গাছ এখন ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমাদের মতো সীমিত সামর্থ্যের কৃষকদের জন্য বড় ধাক্কা।
Advertisement
কোটবাড়ি গ্রামের কৃষক মো. তুহিন আলী জানান, বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, এটা উন্নত জাত, ফলন ভালো হবে। কৃষি অফিস থেকেও প্রদর্শনী প্লট হিসেবে বীজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রতারিত হয়েছি। এই বীজে কোনো ফলন আসেনি।
একই গ্রামের কৃষক মো. ফজলুল হক বলেন, বীজ বপনের সময় আমাদের বলা হয়েছিল যে, এই জাতের ভুট্টায় দ্রুত শিষ ধরে ও ভালো ফলন দেয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে শিষ তো আসেইনি, বরং জমিরও ক্ষতি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঝালকাঠিতে বোরো ধানে কৃষকের মুখে হাসি শিক্ষকতা ছেড়ে ফল চাষে স্বাবলম্বী ছানোয়ার ভোর হতেই জেগে ওঠে ধান কাটা শ্রমিকের হাটপিরোজখালী ও নিমতলা গ্রামের কৃষকেরা জানিয়েছেন, তারা নিজেদের জমানো টাকা ও ধারদেনা করে বীজ, সার ও শ্রমের খরচ চালিয়েছেন। কিন্তু শিষ না আসায় এখন তাদের ঋণ শোধ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে রয়েছেন মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. রাশিদুল ইসলাম, মো. লিটু আলী, মো. ওয়াহেদ আলী, মো. মিজানুর রহমান, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. রাজু, মো. সোহেল রানা, মো. হাফিজুর রহমান, মো. মনিরুল ইসলাম, মো. আশিকুর রহমান ও মো. শাহিনসহ আরও অনেকে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘নাবা জিরো ৫৫’ নামের ভুট্টা বীজটি নিম্নমানের এবং তা থেকে শিষ আসেনি। ফলে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক বিপর্যয়েও পড়তে হয়েছে।
Advertisement
চাষিদের পক্ষে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন সুবদিয়া গ্রামের মো. সরক হোসেন ও কোটবাড়ি গ্রামের মো. মোহাম্মদ আলী। তারা দাবি করেছেন, এসব ভেজাল বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।
বীজ সরবরাহকারী কোম্পানি নাবা ক্রপ কেয়ার লিমিটেডের এরিয়া ম্যানেজার ফিরোজ আহমেদ বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় আমাদের কোম্পানির বীজ বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রায় এক কোটি টাকার বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। অনেক কৃষক আশানুরূপ ফলন পেয়েছেন। তবে গত বছর থেকে ভুট্টা রোগ দেখা দিয়েছে, যা যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে কিছু কৃষকের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মার্কেটিং অফিসারের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। রিটেইলাররা কোম্পানির কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে বীজ নিয়েছেন। এখন তারা কিছু কৃষকের ক্ষতির অজুহাতে আমাদের বকেয়া পরিশোধে গড়িমসি করছেন কিনা, সেটিও আমরা তদন্ত করছি।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। সরেজমিনে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে কৃষকরা বলছেন, শুধু মৌসুমি ক্ষতি নয়, এ ধরনের ঘটনায় কৃষি ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছেন তারা। ভবিষ্যতে কৃষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বীজ অনুমোদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় কঠোর নজরদারির দাবি তাদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভুট্টা উৎপাদনে দেশের শীর্ষ তিন জেলার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা একটি। এ বছর জেলায় ৪৭ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। গত বছরের থেকে এ বছর ৫০০ হেক্টর বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। যা থেকে ৫ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জেলার মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৯৪ হাজার ২২২ হেক্টর
হুসাইন মালিক/এমএন/এএসএম