পহেলা মে বা মে দিবস মানেই আমাদের কাছে কর্মজীবী মানুষের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের দিন। শহরের রাজপথে মিছিল, বক্তৃতা আর লাল পতাকা।
Advertisement
কিন্তু জানেন কি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মে দিবস ঘিরে কিছু অদ্ভুত আবার কিছু হাস্যকর রীতিনীতিও চালু আছে।চলুন, জেনে নেওয়া যাক মে দিবসের সেই ব্যতিক্রমী আয়োজন সম্পর্কে।
ফ্রান্স: মে দিবসে প্রেম ও ‘লিলি ফুল’ফ্রান্সে মে দিবসকে শুধু শ্রমিক দিবস হিসেবেই দেখা হয় না—এই দিনটি ভালোবাসা প্রকাশেরও একটি দিবস। ১৫৬১ সালে রাজা চার্লস নবম এক প্রথা চালু করেন। পহেলা মে প্রিয়জনকে লিলি অব দ্য ভ্যালি ফুল উপহার দিতে হবে। এখনও ফরাসিরা এই দিনে ফুল কিনে বা পথে পথে বিক্রি করে প্রিয়জনকে উপহার দেন। কর্মজীবী প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য দিনটি যেন একযোগে ছুটি ও ভালোবাসা।
ফিনল্যান্ড: ‘ভাপ্পু’ উৎসবফিনল্যান্ডে মে দিবসের নাম ‘Vappu’। এটি শ্রমিক আন্দোলনের স্মরণ ছাড়াও ছাত্র-যুব সংস্কৃতির অংশ। লোকে রঙিন জুতা পরে, প্যান্টের ওপরে কাগজের ফুল লাগিয়ে, হুইসেল বাজিয়ে উৎসব করে। বিশেষ করে হেলসিঙ্কির রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ রঙিন পোশাকে জমায়েত হন। একে বলা হয় ‘সবচেয়ে রঙিন শ্রমিক মিছিল’।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা: ‘লেবার ডে’ সেপ্টেম্বরে!শ্রমিকদের স্মরণে মে মাস নয়, আমেরিকায় ‘লেবার ডে’ পালিত হয় প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার। ১৮৮৬ সালের হেইমার্কেট আন্দোলনের সাথে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সম্পর্ক থাকায় আমেরিকান সরকার মে মাসের দিবস এড়িয়ে যায়!
সুইজারল্যান্ড: ঘাসে ঘুমানোর দিন!সুইজারল্যান্ডের জুরিখে মে দিবসে অনেকেই ঘুরতে বের হন পাহাড়ে কিংবা বনাঞ্চলে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেখানে একদল শ্রমিক ঘাসে শুয়ে ‘ঘুম উৎসব’ পালন করে প্রতিবছর। তাদের মতে, ‘বিশ্রামও একধরনের শ্রমের অধিকার’। এই উদ্যোগকে ‘May Rest’ বলে ডাকা হয়।
জার্মানি: নাচের মধ্য দিয়ে মে-র আগমনজার্মানির কিছু এলাকায় মে দিবসে ‘মে ট্রি’ বা মেপোলি তৈরি হয়—এটি একটি রঙিন খুঁটি যা ফুল ও ফিতা দিয়ে সাজানো হয়। এ রীতির সূচনা হয় ১৬শ শতকের দিকে। লোকজন খুঁটিকে ঘিরে নাচে ও গান গায়। এটিকে বলা হয় ‘Tanz in den Mai’ বা ‘নাচের মধ্য দিয়ে মে-তে প্রবেশ’। এছাড়াও এদিনে এখানে কেউ কেউ প্রেমিক-প্রেমিকাকে খুঁটির নিচে দাঁড়িয়ে প্রপোজও করে।
যুক্তরাজ্য: শ্রমিক নয়, মেঘ দেবীকে জাগানোইংল্যান্ডের বহু গ্রামে মে দিবস মানেই ‘মে কুইন’ উৎসব। এই দিনে একটি মেয়ে শিশুকে রঙিন কাপড় পড়িয়ে, মাথায় ফুলের মালা দিয়ে ‘মে কুইন’ বানানো হয়। তারা বিশ্বাস করে, এই রীতির মাধ্যমে বসন্ত ও প্রাচীন দেবী ফ্লোরাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। শ্রমিকদের কথা পরে আসে।
Advertisement
স্কটল্যান্ড: আগুনের ভেতর দিয়ে ঋতুর সূচনাস্কটল্যান্ডে মে দিবস মানেই বেল্টেন ফায়ার ফেস্টিভ্যাল—যার শেকড় প্রাচীন কেল্টিক বিশ্বাসে। গবাদি পশু ও ফসলকে মন্দ শক্তি থেকে রক্ষার জন্য মানুষ আগুন জ্বালাত, যার ধোঁয়া ও ছাই ছিল শুভ শক্তির প্রতীক। কেউ কেউ আগুনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেত, কেউ আবার লাফিয়ে যেত আগুনের ওপর দিয়ে—সবই ছিল সৌভাগ্যের আশায়। বাড়ির আগুন নিভিয়ে, এই বেল্টেন অগ্নিকুণ্ড থেকেই নতুন আগুন জ্বালানো হতো, যাতে একটি নতুন ঋতুর শুরু হয়।
ওয়েলস: ফুল, হাথর্ন আর দেয়ালের নিচে গানওয়েলসে মে দিবসকে বলা হয় Calan Mai বা Calan Haf, যেখানে রাতভর হাথর্ন গাছের ফুল সংগ্রহ করে বাড়ি সাজানো হয়। তাদের বিশ্বাস, এই ফুল নতুন জীবন ও উর্বরতার প্রতীক। পরদিন লোকজন গাইত May Carol—একধরনের শুভকামনার গান, যা বাড়ির দেয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে গাওয়া হতো। এই গানে থাকতো গ্রীষ্মকে স্বাগত জানানো আর প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানানোর সুর।
পর্তুগাল: মে ফুলে রক্ষা হয় ঘরউত্তর পর্তুগালের মানুষ মে দিবসের আগের রাতে একটি বিশেষ ফুল সংগ্রহ করে—যাকে তারা বলে মাইয়াস, যা মূলত হলুদ ঝাড়ু গাছের ফুল। এই ফুল তারা দরজা, জানালা এমনকি গাড়ির ওপরেও রাখে— তাদের বিশ্বাস, এটা ডাইনি ও খারাপ আত্মা দূরে রাখে। তবে শর্ত একটাই—ফুল রাখতে হবে মধ্যরাতের আগেই।
ইতালি: গান, উৎসব আর জীবনের উদযাপনইতালিতে মে দিবস পরিচিত Calendimaggio বা Cantar Maggio নামে। ল্যাটিন ‘কালেন্ডা মাইয়া’ থেকে আগত এই উৎসব বসন্ত আর জীবনের পুনর্জন্ম উদযাপন করে। বিভিন্ন গ্রামে হয় লোকগান, রঙিন সাজসজ্জা আর পথে পথে নাচ-গান। উৎসবটির ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল রোমান বা তারও আগে, এমনকি এট্রুস্কান সভ্যতায়ও এর ছাপ মেলে।
আয়ারল্যান্ড: বেল্টেন থেকে মেরি পর্যন্তআয়ারল্যান্ডে মে দিবসের ইতিহাসও বেল্টেন উৎসব থেকে আগত। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, এই দিনে সৌভাগ্য কামনায় জ্বালানো হতো অগ্নিকুণ্ড, কখনো কখনো পশুরা সেই আগুনের চারপাশ ঘুরে বেড়াত। আধুনিক আয়ারল্যান্ডে এটি সরকারি ছুটির দিন, তবে গ্রামীণ এলাকায় কিছু আগুনের প্রথা এখনও টিকে আছে।
চেক প্রজাতন্ত্র: প্রেমের চুমু আর মেপোলচেক প্রজাতন্ত্রে মে মাস ভালোবাসার মাস। ৩০ এপ্রিল স্থাপন করা হয় একখানা রঙিন মেপোল (স্থানীয়ভাবে মাজকা)—এর নিচে প্রেমিক-প্রেমিকারা দাঁড়িয়ে চুমু খায়, যাতে তাদের প্রেম অটুট থাকে। আগুন জ্বালানো হয় সেই রাতেই, যা বেল্টেন ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
রোমানিয়া: কুসংস্কার আর গরুর ছুটিরোমানিয়ায় মে দিবস মানেই কুসংস্কার! এদিনকে বলা হয় আর্মিন্ডেন বা ‘ষাঁড় দিবস’। গরুকে কাজে লাগানো নিষেধ, না হলে মালিক অসুস্থ হতে পারেন—এমন বিশ্বাস আছে। মাঠের কাজ বন্ধ থাকে, ঘরদোর পরিষ্কার হয় না, সবই অপশক্তি ঠেকানোর প্রয়াস।
বুলগেরিয়া: সাপভীতির উৎসববুলগেরিয়ায় মে দিবস পরিচিত ইরমিনডেন নামে। এদিন মূলত সাপ আর টিকটিকিকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর উৎসব! গ্রামের লোকজন আগুন জ্বালিয়ে তার ওপর লাফায়, শব্দ করে, যাতে এসব প্রাণী পালিয়ে যায়। গর্ভবতী নারীরা রুটি বানায় বিশেষ মাটির পাত্রে, সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
এমআইএইচ/জিকেএস