‘যা-ই আবাদ করি লসের মুখে পড়তে হয়। আর যখন লস হয়, সংসারে অভাব ঢোকে। তখন পরিবারের লোকও দাম দেয় না। কিন্তু এসব কার কাছে বলবো, কে শুনবে। তাই জমির আইল দিয়ে হাঁটি আর নিজের দুঃখের কথা নিজের কাছেই কই।’ নিজের অসহায়ত্ব ও দুঃখ প্রকাশ করে আক্ষেপে এমন মন্তব্য করেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়ালের কৃষক আব্দুল হাকিম।
Advertisement
মে দিবস বা বিশ্ব শ্রমিক দিবসে নানা অধিকার ও ন্যায্যতার কথা উঠলেও কৃষকদের শ্রমের মূল্য নিয়ে কে ভাবে? কে শোনে কৃষকের দুঃখগাথা? এমন প্রশ্ন পাবনার কৃষকদের।
কৃষকের ভাগ্য বিড়ম্বনা জানতে পাবনার সুজানগর উপজেলার কোলচুরী গ্রামের পেঁয়াজচাষি মো. বাপ্পির সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। বাপ্পি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এটি যেমন তার কাছে গর্বের, ঠিক একইভাবে চাষির পরিচয়টিও তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গেই দিয়ে থাকেন। তিনি গত মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। ফলন খুব ভালো না হলেও ন্যায্যদাম পেলে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সে স্বপ্নের গুঁড়ে বালি পড়ে। আবাদ খরচের অর্ধেকও তুলতে পারেননি।
বাপ্পি জানান, ঋণ নিয়ে রক্ত, ঘাম ও শ্রমে তিলে তিলে জমি থেকে ঘরে তোলা হয় উৎপাদিত ফসল। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না নিশ্চিত করায় সেটি রক্তাক্ত হয়।
Advertisement
এ কৃষক জানান, গত মৌসুমে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদে লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার বা কারো আরও বেশি খরচ হয়েছে। এর বিপরীতে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করায় অর্ধেকেরও বেশি লোকসান হয়েছে কৃষকদের। কেউ কেউ হালের সবকয়টি গরু ছাগল বিক্রি করে আবাদে নামেন। কেউবা বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নেন। এই ঋণের টাকা কীভাবে শোধ হবে, সেটি কেউ জিজ্ঞেস করেছে? লোকসানে কৃষকরা বাপ দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ফুরিয়েছেন। বড় বড় অনেক গৃহস্থ এখন অন্যের জমিতে দিন খেটেও খান। যখন তারা এসব দুঃখের কথা বলেন তখন নির্বাক হতে হয়। আর ভাবতে হয়, কেউ নেই এদের এমন বোবাকান্না দেখার বা শোনার।
তিনি বলেন, শ্রমিক দিবসে অন্তত পরিবহন শ্রমিক ও গার্মেন্টস শ্রমিকসহ অন্যান্যদের নানা দাবি তোলা হয়। তাদের সংগঠন বা পরিষদ আছে। কৃষকের এসবের কিচ্ছু নেই। তাই মে দিবসেও তাদের কথা কেউ বলে না, বলবেও না।
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, বর্তমানে জেলায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮৩টি। এরমধ্যে ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ টিই কৃষক পরিবার। অর্থাৎ জেলার মোট পরিবারের ৭৭ শতাংশই কৃষক পরিবার। যারা কৃষিতে দফায় দফায় লোকসানের মুখে পতিত হয়েও এ খাতে লড়াই করছেন।
পাবনা সদর উপজেলার ভাঁড়ারা ইউনিয়নের জোত চাকুরিয়া গ্রামের কৃষক মিজান বলেন, এই যে ধরেন গাভি পালন করি। এর দুধ ব্যাপারী এসে নিয়ে যায় ৪০-৪৫ টাকা দামে। অথচ শহরেই এগুলো ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়। আমাদের ঠকানো হয়। একই কাহিনি ধান বা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও। প্রতিবছর কোনো না কোনো ফসলে লোকসান হবেই। একটা নিরাপত্তাই আছে ভাই, সেটা হলো তরকারি যাই হোক, ভাতটা ঘরে থাকে। না খেয়ে থাকার ভয়টা নাই। আবার খুব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যও নাই।
Advertisement
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকদের নেই কোনো সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো শ্রমিক ইউনিয়ন। আর তাই তাদের মৌলিক মানবিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নানা সমস্যা গুরুত্ব পায় না। কৃষি শ্রমিকদের শ্রমিক শ্রেণির অংশই মনে করা হয় না। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে প্রান্তিক কৃষকরা ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে এদের কেউ বর্গাচাষি আবার কেউবা কৃষি দিনমজুর। অনেকেই বদলেছে নিজ পেশা। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার বালাই নেই কৃষকদের। প্রখর রোদে তারা কাজ করলেও বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ ও জায়গা নেই। অধিকাংশ কৃষক মাঠে-ঘাটের খোলামেলা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই খাওয়া দাওয়া করে থাকেন। পান করেন অনিরাপদ পানি। এসব সমস্যা সমাধানে বা কৃষকবান্ধব কোনো পদক্ষেপ নিয়ে কেউই এগিয়ে আসেন না। ফলে উপেক্ষিত থেকেই যায় তাদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য অধিকার।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়ালের কৃষক আব্দুল হাকিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুখে অনেকে অনেক কথা বললেও এই সমাজে কৃষক সবচেয়ে ছোট মাপের মানুষ। এদের কেউ দুই পয়সার দামও দেয় না। থাকি লুঙ্গি পরে, কে কি দাম দেবে ভাই। গত আমন মৌসুমে ১৬ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। এরমধ্যে ১১ বিঘা জমির ধান মাইর (নষ্ট) খেয়েছে। বিল এলাকা হওয়ায় খরচ কম হলেও প্রতি বিঘায় কমপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা করে খরচ হয়। এই যে লোকসানটা খেলাম, এর জন্য আহা, উহু করেও লাভ নাই। কারণ শোনার মতো কেউ নেই। আমরা রাগও করতে পারি না। রাগ করে কী করবো, মরলেও আমাদের চাষবাস ছাড়া উপায় নাই।’
এমন দুঃখ ও কষ্টের ভারে ন্যুব্জ হয়ে অনেকেই হাল ছেড়েছেন। ফলে উদ্বেগজনক হারে কমতে শুরু করেছে কৃষকের সংখ্যা ও আবাদি জমি। পাবনা জেলা পরিসংখ্যান অফিসের কৃষি শুমারির তথ্য বলছে, পাবনায় ২০০৮ সালে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ছিল জেলার মোট জনসংখ্যার ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। যা কমে ২০১৯ সালে হয় ৪৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমিক ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা। একই শুমারি অনুযায়ী ২০০৮ সালে জেলায় কৃষি শ্রমিক (দিনমজুর) ছিল ৫৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। যা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ দশমিক ৯৯ শতাংশে। অর্থাৎ কৃষি দিনমজুরের সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কৃষকের সংখ্যা।
এদিকে জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভূমিহীন কৃষক পরিবার ছিল ৮৩ হাজার ৪০টি। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ১৪০টি। অর্থাৎ গত ৩-৪ বছরে ১০০টি কৃষক পরিবার ভূমিহীন হয়েছে। শুধু কৃষক বিবেচনায় এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা অনেকের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি শ্রমিক তথা কৃষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কৃষি ও কৃষককে উপেক্ষা করে দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখা সম্ভব নয়। অথচ তারা সব সময়ই অবহেলিত।
এ ব্যাপারে দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ অধ্যাপক মো. জাফর সাদেক জাগো নিউজকে বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কোনোদিনই কৃষিতে উন্নয়ন সম্ভব হবে না। কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন যদি ঘটানো যায়, তাহলে কৃষিতে এমনি এমনিই উন্নয়ন ঘটবে। এটি কৃষকরাই করবে। এক্ষেত্রে আগে কৃষকদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে। কৃষকদের এদেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের আলাদা করে পরিচয়পত্র দিতে হবে। তারা যেন ব্যাংক লোন বা অন্য যেকোনো অফিস আদালতে অগ্রাধিকার পান।
তিনি বলেন, কৃষকদের আমরা মানুষ হিসেবে গণ্য করি না। তাদের বলি পা ফাটা চাষা। এসব ন্যারেটিভ বা নেতিবাচক মনোভাব যতদিন থাকবে ততদিন কৃষকের উন্নয়ন হবে না। কৃষককে মানুষ ও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পরিবহন ও অন্যান্যসহ গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকরাও মে দিবসের অনুষ্ঠানে দল বেঁধে আসেন। ঠিক একইভাবে যদি আমরা কৃষকদের আনতে পারতাম তাহলে অসাধ্য সাধন করা যেতে পারে। তাদের আগে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল সিন্ডিকেটকে এ সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। সরাসরি ভোক্তা এবং কৃষকের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে হবে। ঢাকা বা দূরের ক্ষেত্রে মাত্র একটি মাধ্যম রাখা যেতে পারে। তাহলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে।
কৃষি শ্রমিকদের (কৃষক) সর্বোচ্চ মর্যাদা পাওয়া উচিত জানিয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, শ্রমিকদের মাঝে র্যাঙ্কিং করলে কৃষককে টপ প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে তাদের কৃষি শ্রমিকের মর্যাদা দিয়েছি। সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখা, প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করাসহ তাদের আমরা কৃষি বিভাগ সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে থাকি। এর বাইরে তাদের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে তারা অনেকটা মূল্যায়িত হবেন। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। কারণ তাদের আর্থিকভাবে সচ্ছলতা বাড়াতে হবে। এছাড়া তাদের সামাজিক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবাও দেওয়া উচিত। এগুলো আমাদের প্রস্তাবনা থাকবে।
এফএ/জিকেএস