‘কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। এত বড় অঙ্কের টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় পরে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে ১২ লাখ টাকা ব্যক্তিগত ঋণ নেন। পরে আরও কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দিতে চান। রাজি না হওয়ায় অন্যকে কাজ দিয়ে দেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ঋণের টাকা ফেরত দেননি। বরং ওই টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন লোক দিয়ে ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।’
Advertisement
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মো. মাসুম ইফতেখারের (বর্তমানে ওএসডি) বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন একজন ঠিকাদার। প্রমাণ হিসেবে তাদের দুজনের এ সংক্রান্ত কথোপকথনের রেকর্ড জাগো নিউজের হাতে এসেছে। তবে সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার নিজেকে দাবি করছেন নির্দোষ।
জানা গেছে, ২০২২ সালের দিকে একটি টেন্ডারে নোয়াখালীর সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দপ্তরে নোটিশ করে ‘সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড’। সেই সূত্র ধরে সিভিল সার্জন তাদের সঙ্গে বসেন। কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। রাজি না হওয়ায় বাবার অসুস্থতার কথা বলে ১২ লাখ টাকা নেন। পরে আরও টাকা দাবি করেন। সেই টাকা না দেওয়ায় কাজ দিয়ে দেন অন্য ঠিকাদারকে। কিন্তু ‘সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড’র প্রতিনিধি থেকে নেওয়া টাকা আর ফেরত দেননি। নানান দেনদরবারের পর এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিলেও বাকি টাকা দিচ্ছেন না। বরং এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, তিনি ‘সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ‘সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি, এটি সত্য। কিন্তু তার (সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড) লাইসেন্স ব্যবহার করে টেন্ডারে অংশ নেওয়া ওয়েলট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. মাহফুজুর রহমানের (রবিন) কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। হোয়াটস অ্যাপে এ সংক্রান্ত কথোপকথনের রেকর্ড এবং ব্যাংক ও বিকাশে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
Advertisement
ওয়েলট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাহফুজুর রহমান (রবিন) জাগো নিউজকে বলেন, “আমি আমার বড় ভাইয়ের ‘সরকার আউটসোর্সিং অ্যান্ড সিকিউরিটি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করি। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও আমাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগীয় কার্যালয়ে অভিযোগ দেই। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ টেন্ডারের বিষয়ে সিভিল সার্জনকে অবগত করা হয়। তখন সিভিল সার্জন আমাকে কল দিয়ে তার সরকারি বাসভবনে দাওয়াত দেন। আমি সাক্ষাৎ করি। সিভিল সার্জন আমার কাজ থেকে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। কারণ জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, ওপর মহলে টাকা দিতে হবে। পাশাপাশি যাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে তাকেও টাকা দিতে হবে। আমি প্রথমে রাজি হই নাই। পরে সিভিল সার্জন আবার ঢাকায় আসেন আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। তখন আমাকে অভিযোগ ওঠানোর জন্য বলেন। এছাড়া ২০ লাখ টাকা দিলে কাজ দেবেন বলেন। আমি বলেছি, টাকা দিয়ে কাজ নেব না।”
আরও পড়ুনঘুষ নিয়ে এমপিওভুক্তির ‘রেকর্ড’ নাসিরের, মোতালেবও কোটিপতিভূমি অফিসে ঘুষ বাণিজ্য, দুদকের ৮ ঘণ্টার অভিযান৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ায় কর কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্তমাহফুজুর রহমান বলেন, এর ঠিক দুদিন পর আবার এসে সিভিল সার্জন বলেন, তার বাবা খুবই অসুস্থ। জরুরি টাকা দরকার। তখন আমি ১২ লাখ টাকা দিই। সিভিল সার্জন বলেন, যদি কাজটা দিতে পারে, তাহলে আরও টাকা দিতে হবে। আমি হ্যাঁ অথবা না কিছু বলিনি। কিছু দিন যাওয়ার পর আমাকে কল দিয়ে আবার সাক্ষাৎ করেন। তখন বলেন, কাজটি আপনাকে দেবো। কিন্তু আরও ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। না হলে আরেক ঠিকাদারকে দিয়ে দেবো। তখন আমি বলেছি, আমার কাজ লাগবে না। আপনি যে টাকা নিয়েছেন আপনার বাবার অসুস্থতার কথা বলে, সে টাকা ফেরত দেন। সিভিল সার্জন টাকা দিয়ে দেবেন বলে চলে গেছেন। পরে অন্য ঠিকাদার কাজ পেয়েছে।
‘এর মধ্যে আমাকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। বলে বাকি টাকা দেবে অভিযোগ ওঠানোর পর। আমি অভিযোগ ওঠাইনি। তখন সিভিল সার্জন বিভিন্ন মহল থেকে কল করান এবং আমাকে ভয় দেখানো হয়। আমি সাক্ষাৎ করার জন্য নোয়াখালী যাই। সেখানে গুন্ডা বাহিনী দিয়ে ভয় দেখিয়ে অভিযোগ ওঠাতে বাধ্য করে। টাকার কথা বললে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেখায়। এ বিষয়গুলো নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনেক দরখাস্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এখন ২০২৫ সাল, এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সুষ্ঠু বিচার হয় নাই। কারণ সিভিল সার্জন আমাকে সরাসরি বলেন, আমার কোনো অভিযোগ সিভিল সার্জনের কিছু করতে পারবে না। সব জায়গার লোক সিভিল সার্জনের কথায় উঠে বসে।’ যোগ করেন ওই ঠিকাদার।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলার তৎকালীন সিভিল সার্জন (গত ১ মার্চ থেকে ওএসডি) মো. মাসুম ইফতেখার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ভাই আর্কিটেক্ট। আমাদের বাবা অসুস্থ হলে চিকিৎসা করার সামর্থ্য আছে। ‘সরকার আউটসোর্সিং মাহফুজুর রহমান সিকিউরিটি লিমিটেড’ অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান সেলিম ভাই থেকে আমি কোনো টাকা নেইনি। আপনি প্রয়োজনে উনার সঙ্গে কথা বলেন। টেন্ডার সংক্রান্ত অভিযোগটি ২০২২ সালের। উনাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকবার সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য ডাকা হয়েছে। কিন্তু তারা আসেনি।’
Advertisement
সরকার আউটসোর্সিং মাহফুজুর রহমান সিকিউরিটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান সেলিম বলেন, এক ছোট ভাই আমার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করে টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল। কাগজপত্র ও অভিজ্ঞতাসহ সব বিবেচনায় কাজ আমার প্রতিষ্ঠানই পাওয়ার কথা। কিন্তু দেয় নাই। টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়েছে। এ নিয়ে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কোনো সমাধান পাইনি। সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য কেউ আমাদের নোটিশও করেনি।
এসইউজে/এমএইচআর/এমএফএ/জেআইএম