ফরিদপুরের বোয়ালমারীর জয়নগর গ্রামে এখনো তালপাতা দিয়ে বানানো হাতপাখার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কারিগররা। চৈত্র মাসে গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় হাতপাখার চাহিদা। ব্যতিক্রম হয়নি চলতি গরমেও। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের প্রায় ৪২টি পরিবার বাপদাদার এ পেশায় জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। হাতপাখা তৈরির কারণে ‘পাখা গ্রাম’ নামেও পরিচিত হয়েছে জয়নগর। এ গ্রামের কমপক্ষে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় যুক্ত রয়েছেন। তবে দিন দিন কমছে তালগাছের পরিমাণ।
কারিগররা জানান, তালগাছ সংকটের কারণে পাতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। মালপত্রের দাম বাড়ায় পাখা তৈরির কাজে লাভ হয় না বললেই চলে। ১০০টি পাখা বানাতে খরচ পড়ে প্রায় দুই হাজার টাকা। প্রকারভেদে বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের এমন কোনো বাড়ির আঙিনা নেই যেখানে কাঁচা তালপাতা শুকানো হচ্ছে না। পুরুষরা তালগাছের কাঁচা পাতা ও বাঁশের কাজ করছেন। নারীরা কেউ করছেন সুই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধানো কাজ। কেউ ব্যস্ত রঙের কাজে। এমনকি তাদের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া সন্তানেরাও বসে নেই। পড়ালেখার পাশাপাশি মা-বাবাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন।
Advertisement
আরও পড়ুন:
শরিফুলের ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে বাধা পাপড় বিক্রি করে সংসার চলে হারুন-মজিদা দম্পতিরছামিরুদ্দিন(৭৬) নামের একজন বৃদ্ধ জাগো নিউজকে বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে এ পেশায় জড়িত। এখনো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। তবে আগের মতো তালগাছ নেই। পাতা পাওয়া যায় না। সবকিছুর দামও বেড়ে গেছে। এসব কারণে এই কাজে এখন আর পয়সা নেই। যদি সরকারি সহায়তা বা বিনা সুদে ঋণ পাওয়া যেতো, তাহলে হয়তো এই পেশা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।
ভানু বেগম নামের আরেক বৃদ্ধা বলেন, ‘প্রতিদিন ৪০-৫০টি পাখা তৈরি করি। বয়সের কারণে আগের মতো পারি না। তালপাতা কিনতে হয়। কেনার মতো পুঁজি নেই। কোনমতে পেটের দায়ে এ পেশায় টিকে আছি।’
কথা হয় পাখা তৈরির কারিগর শাহজাহান শেখের জন্য। তিনি বলেন, ‘একেকটি তালপাতা কিনতে হয় ১৫ টাকা দিয়ে। বাঁশ, সুতালি ও রং দিয়ে প্রতিটি পাখা বানাতে খরচ পড়ে কমপক্ষে ২০ টাকা। অথচ পাখা বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। সবমিলিয়ে লাভ থাকে খুবই কম। এ আয়ে সংসার চালাতে হয় খুব কষ্ট করে। কোনোরকমে এ পেশায় টিকে আছি।’
Advertisement
আসলাম বিশ্বাস নামের আরেকজন বলেন, ‘বাপ-দাদার কাছ থেকে পাখা বানাতে শিখেছি। তবে লাভ থাকে না বললেই চলে। তারপরও পেশা বদল করতে না পারায় এ কাজ ছাড়তে পারছি না।’
উঠানে বসে পাখা তৈরির কাজ করছিলেন গৃহবধূ রোকেয়া বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারা বছর নয়, গরমের সময় পাঁচ মাস পাখা বানানোর কাজ করি। তার মধ্যে আবার তিন মাস চাহিদা বেশি থাকে। তবে পাখা তৈরির উপকরণের দাম বেশি। তাই লাভ কম হচ্ছে। এ কাজে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালাতে হচ্ছে।’
সাতৈর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রাফিউল আলম মিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘তালপাতার পাখা তৈরির পেশাটি সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগরের মানুষ এখনো ধরে রেখেছেন। এ পেশায় জড়িতদের সমস্যার কথা শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে ইউএনও ও বিসিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তারা যাতে স্বল্প সুদে ঋণ পান, সে ব্যবস্থা করা হবে।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ফরিদপুর কার্যালয়ের প্রমোশন কর্মকর্তা মাইনুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, পাখা তৈরির গ্রামে গিয়ে কারিগরদের চাহিদার কথা শোনা হবে। তারা যদি আগ্রহী হন তাহলে তাদের ঢাকায় উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। পাখা বিক্রির ব্যবস্থাও করা হবে। স্বল্পসুদে ঋণ পেতে সহায়তা করা হবে।
এসআর/এমএস