দেশজুড়ে

এক গরু থেকে শত গরুর মালিক আমিরুল

এক গরু থেকে শত গরুর মালিক আমিরুল

মায়ের নির্দেশে ১৪ হাজার ৬শ টাকা দিয়ে একটি গরু কেনেন। সেই এক গরু থেকে এখন শতাধিক গরুর মালিক তিনি। প্রতিদিন তার খামারে ৪৫০ থেকে ৫০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। দুধ ও গরুর বাছুর বিক্রি করে প্রতিবছর আয় করেছেন লাখ লাখ টাকা। গরু থেকে দুধ সংগ্রহের পাশাপাশি গোবর থেকে বায়োগ্যাস, কেঁচো কম্পোস্ট জৈব সার ও ট্রাইকো ডার্মা জৈব সার উৎপাদন করছেন। গরুর খামারের পাশাপাশি তিনি মহিষ, গাড়ল ও মুরগি পালন করছেন।

Advertisement

পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দেশসেরা খামারি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। এছাড়াও খামারি ও কৃষকদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার ‘অ্যাগ্রিকালচার ইম্পর্ট্যান্ট পারসন’ (এআইপি) পদক তিনি অর্জন করেছেন।

আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিও মজিনা তার খামার পরিদর্শন করে অভিভূত হয়ে তাকে পিঠ চাপড়ে বলছিলেন, ‘তোমার খামার দেখে আমি অভিভূত ও মুগ্ধ। তুমি সফলতার পথে এগিয়ে চলো।’

বলছিলাম পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার খামারি আমিরুল ইসলামের সফলতার গল্প। তার এ সফলতার পথ এত মসৃণ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম, কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি নানান সংকট ও সমস্যার মোকাবিলা করে একজন সফল খামারি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন-

কেঁচো কম্পোস্ট সার বানিয়ে রোল মডেল শিখা রানী গৃহিণী থেকে দেশসেরা কৃষক সাহিদা হাতের কাজ শিখে হাজারো নারী স্বাবলম্বী

সফল খামারি আমিরুল ইসলাম উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের বরমপুর গ্রামের মৃত নবীর উদ্দিন ও মৃত আমেনা খাতুন দম্পতির ছেলে। আমিরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে বিএসসি পড়াকালীন তার বাবা নবীর উদ্দিন মারা যান। ৭ ভাই-বোনের মধ্যে আমিরুল ইসলাম ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। বাবার মৃত্যুর পর ছাত্রজীবনে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। সংসার সামলাতে গিয়ে তাকে পড়াশুনা জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল।

মায়ের নির্দেশে কেনা গাভীর দুধ ও বাছুর বিক্রির জমানো টাকা ও মায়ের কাছ থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে তিনি খামার তৈরির জন্য একটি শেড নির্মাণ করেন। এভাবেই শুরু হয় আমিরুল ইসলামের বাণিজ্যিক খামারের যাত্রা। প্রতিবছর খামারে গাভীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বড় হতে থাকে খামারের পরিসর। ৩০ বছরে সেই খামারের সফলতার গল্প এগিয়েছে বহুদূর।

২২ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার ‘তন্ময় ডেইরি ফার্ম’ এখন দেশের খামারিদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। তাইতো গরুর দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠায় সরকারি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী শত শত খামারি আমিরুল ইসলামের তন্ময় ডেইরি ফার্ম পরিদর্শনে আসেন এবং তার কাছ থেকে খামার তৈরির পরামর্শ গ্রহণ করেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তার খামার পরিদর্শনে আসেন।

Advertisement

আমিরুল ইসলামের কাছে খামার গড়ে তোলার গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে আমি যখন বিএসসি পরীক্ষার্থী তখন আমার বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের চাষাবাদ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতে থাকা গরু-ছাগল বিক্রি করে দিই। ১৯৯৪ সালে আমার মা বললেন, আমরা ভাতের মাড় ও তরিকারির উচ্ছিষ্ট ফেলে দেওয়ায় অভ্যস্ত না। এগুলো গরু-ছাগলকে সারাজীবন খাইয়েছি। একটি গরু কেনার ব্যবস্থা কর। মায়ের নির্দেশে ১৯৯৪ সালে ১৪ হাজার ৬শ টাকা দিয়ে পাশের গ্রাম থেকে শংকর জাতের একটি গাভী গরু কিনি। প্রতিবছর এ গরু থেকে যে বাছুর হতো এগুলোর মধ্যে যেগুলো গাভী সেগুলো রেখে দিতাম। এভাবেই একটা একটা করে গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম গরুর খামার করবো।

এক গরু দিয়ে শুরু করলেও এখন খামারে শতাধিক গরু রয়েছে। এ খামারের গরু লালন-পালনসহ বিভিন্ন কাজে ৮ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সফল খামারি আমিরুল ইসলাম বলেন, নিজে একা খামার করে কখনো নিজের বা এলাকার উন্নয়ন করা যায় না। তাইতো আমি নিজে খামার গড়ে তোলার পাশাপাশি এ গ্রামের শতাধিক মানুষকে খামার করার উৎসাহ দিয়েছি। অনেকেই খামার করে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করেছেন। নিজ গ্রামের খামারিদের কাছে আমার খামারের বাছুর বিক্রি করছি। যাতে উন্নত জাতের বাছুর লালন পালন করে তারা দ্রুত খামারের উন্নয়ন করতে পারে।

তিনি বলেন, গ্রামে শতাধিক খামারিদের নিয়ে ‘পাকুড়িয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি.’ নামে একটি সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছি। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সমিতির অধীনে একশোর বেশি সদস্য রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত দুধ মিল্ক ভিটায় যায়। এছাড়াও স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এখানকার হাট-বাজারে এসব খামারের দুধ বিক্রি হয়।

তিনি আরও বলেন, ২২ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ খামারে দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি গরুর গোবর থেকে তৈরি করছি বায়োগ্যাস। এ গ্যাস দিয়ে আমার দুইটি জেনারেটর ও নিজ বাড়িসহ আশপাশের বাড়ির রান্না-বান্নার কাজ চলছে। গোবর থেকে কেঁচো কম্পোস্ট জৈব সার ও ট্রাইকো ডার্মা জৈব সার উৎপাদন হচ্ছে। যা বাজারজাত করে অর্থ উপার্জন করছি। এছাড়াও খামারের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ঘাস চাষ। গরু লালন-পালন করতে হলে ঘাস চাষের বিকল্প নেই। এ খামারে মহিষ, গাড়ল ও মুরগি পালন করছি। গাড়ল ও মুরগি দিয়ে পরিবারের মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করতেও পারছি।

খামার কীভাবে লাভজনক হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খামারিদের শুধু গরুর দুধের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। গরুর গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদন করতে হবে। গরুর খাদ্যের প্রধান উপকরণ ঘাস চাষের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিজস্ব ঘাস চাষের ব্যবস্থা থাকলে সেই খামারি অবশ্যই সফল হবে। ঘাসের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার গরুকে দিতে হবে। কিন্তু খামারিকে বুঝতে হবে ঘাসই গরুর প্রধান খাবার। খামারিদের আবেগি হলে চলবে না। গাভী গরু কিনে খামার দিলে সেটি টেকসই হওয়া কঠিন হবে। খামারিদের বাছুর গরু দিয়ে খামার শুরু করতে হবে। যাতে এ বাছুর যখন পরিপূর্ণ গরুতে পরিণত হবে তখন তার পূর্ণ ধারণা ও অভিজ্ঞতা তৈরি হবে।

তিনি বলেন, আমার খামারে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য ২২ হাজার থেকে ২৬ হাজার টাকা। এছাড়া গরুর বাছুর, গাড়ল, মুরগির ডিম ও জৈব সার বিক্রি হয়। আমার মতো খামারিরা শ্রমিকের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও ৩০ লাখ টাকা আয় করতে পারে। দুগ্ধ খামার নির্মাণ করতে হলে খামারিকে অবশ্যই গরু পালনের পাশাপাশি আমার মতো অন্যান্য কাজও করতে হবে। তবেই খামার লাভজনক হবে এবং খামারি সফলতা পাবেন।

আমিরুল ইসলামের কাছে তার সফলতা ও অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদ্মা বিধৌত চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপথের একজন সাধারণ মানুষ আমি। দুগ্ধ খামার গড়ে আমি যে সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছি এজন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার খামার পরিদর্শনে এসেছিলেন আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিও মজিনা। সরকারের বিভিন্ন সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিজ্ঞানী ও গবেষকগণসহ শত শত খামারি ও শিক্ষার্থী আসেন। এটি আমার জীবনের বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি। এছাড়াও খামারের জন্য ২০১২ সালে জাতীয় খামার ব্রোঞ্চ পদক, ২০১৩ সালে জাতীয় সমবায় পদক, প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার, ময়মনসিংহ কৃষি বিদ্যালয় থেকে সম্মাননা, বগুড়া আরডিএ থেকে সম্মাননা, ২০২১ সালে ডেইরি আইকন স্বর্ণপদক, ২০২২ সালে জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক, ২০২৪ সালে অ্যাগ্রিকালচার ইম্পর্ট্যান্ট পারসন (এআইপি) পদক অর্জন করি।

সফল খামারি আমিরুল ইসলামের আগামী দিনের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন এই এলাকায় বৃহৎ আকারে দুধের পল্লি গড়ে তোলা। এখানে শুধু দুধ উৎপাদন নয়। দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার তৈরি করে তা বাজারজাত করা।

খামারি আমিরুল ইসলাম সম্পর্কে তার নিজ এলাকার বরমপুর গ্রামের খামারি ইদ্রিস আলী বলেন, আমিরুল ইসলামের পথ অনুসরণ করে বরমপুর গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে শত শত ছোট-বড় খামার গড়ে উঠেছে। আমাদের প্রতিটি খামারে বায়োগ্যাস প্লান্ট রয়েছে। অনেকেই গোবর থেকে জৈব সার উৎপাদন করে নিজ জমিতে ব্যবহার ও বিক্রি করছেন। আমাদের কোনো খামারির বা গরুর কোনো সমস্যা হলে আমিরুল ভাই তাৎক্ষণিক ছুটে আসেন। তার সহযোগিতায় অতি সহজেই অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়ে যায়। তিনি অত্যন্ত বড় মনের মানুষ। একজন আদর্শ খামারি হিসেবে সরকার তাকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করে মূল্যায়ন করেছেন। তার এ সফলতার জন্য বরমপুরগ্রামসহ পুরো উপজেলাবাসী গর্বিত।

ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন বলেন, আমিরুল ইসলাম একজন সফল খামারি। তিনি তার সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন জাতীয় পদক অর্জন করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করে আসছি।

এফএ/জেআইএম