দেশজুড়ে

ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছিল তোহান, সেটাও হাতিয়ে নিলো প্রতারক

ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছিল তোহান, সেটাও হাতিয়ে নিলো প্রতারক

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাসিন্দা তাহাজ্জত হোসেন তোহান। বয়স আনুমানিক ১৪ বছর। এই বয়সে যখন তার বন্ধুদের কেউ বইখাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যায়, তখন কিশোর তোহানের কাঁধে বড় দায়িত্ব। দরিদ্রতার কাছে হার মেনেছে তার পড়াশোনা। মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে।

Advertisement

ঋণের টাকায় শুরু করে ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালানো। ভ্যান চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়েই দিনশেষে দু-তিন কেজি চাল কিনে বাড়ি ফিরতো সে। তা দিয়েই কোনোমতো চলছিল তার সংসার।

অথচ বেঁচে থাকার সেই অবলম্বনটুকুও কৌশলে হাতিয়ে নিলো একটি প্রতারক চক্র। সোমবার (২১ এপ্রিল) দুপুরে চক্রটি তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এখন পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কিশোর তোহান। কোনো উপায় না পেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে রাজমিস্ত্রির ভারী কাজ শুরু করেছে সে।

তোহান উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের বেড়মানিক গ্রামের দিনমজুর সোহেল রানার ছেলে। বর্তমানে তার পরিবারে মা জাহানারা খাতুন (৩০), দুই ভাই ইয়ামিন (৬) ও ইয়াসিন (৫) রয়েছে। তার বাবা মাসখানেক হলো জীবিকা অর্জনের জন্য হাওর এলাকায় অবস্থান করছেন।

Advertisement

শনিবার (২৬ এপ্রিল) সকালে দেখা যায়, বেড়মানিক গ্রামের আব্দুর রহমানের বাড়িতে শ্রমিকদের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে তোহান। কখনো রড বাঁধা আবার কখনো ইট টানার কাজ করছে সে।

এসময় আলাপকালে কিশোর তোহান ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে, ‌‘আব্বা গরিব মানুষ। একার আয়ে সংসার চলে না। সেজন্য তিন বছর আগে ক্লাস থ্রি থেকে পড়া বাদ দিয়ে ভ্যান চালাচ্ছিলাম। দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হতো। চলছিল কোনোমতো। কিন্তু সোমবার একটি চক্র প্রতারণা করে ভ্যানটি নিয়ে গেছে। এখন বাড়িতে খাবার নাই। তাই রাজমিস্ত্রির কাজ করছি।’

কথা বলে জানা যায়, সোমবার দুপুরে অজ্ঞাতপরিচয় একজন কুমারখালী হলবাজার থেকে কিশোর তোহানের ভ্যানটি ভাড়া করেন। এরপর কুমারখালী রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছালে তাদের সঙ্গে আরও একজন যোগ দেন। এরপর তারা কুষ্টিয়া বড় বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে লাহিনীপাড়া এলাকায় ভ্যানটি থামিয়ে তোহানকে ব্যাগ কিনতে পাঠায় প্রতারক চক্রটি। তোহান ব্যাগ কিনে ফিরে দেখে ভ্যান ও লোকগুলো নেই। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে ভ্যান পায়নি।

রাজমিস্ত্রি মনছের বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তোহানের মা বলছিল বাড়িতে খাবার নেই। সেজন্য তাকে কাজে নিয়েছি। কিন্তু ও তো (তোহান) ছোট মানুষ। ভারী কাজ করতে পারে না। বাড়ির লোকতো কাজে নেবে না। চুক্তিভিত্তিক কাজ বলে মানবিক কারণে নিছি। দিনে ৫০০ টাকা করে দিচ্ছি।’

Advertisement

বাড়ির মালিক আব্দুর রহমান বলেন, ‘এলাকায় সবচেয়ে গরিব ওরা। অসহায় মানুষ। ভ্যান চালিয়ে খাচ্ছিল। তাও চুরি হয়ে গেছে। সরকার যদি একটা ভ্যান কিনে দিতো, তাহলে আবার চলে ফিরে খেতে পারতো।’

সরেজমিন তোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতাংশ জমির ওপর দুই কক্ষবিশিষ্ট চারচালা টিনের ঘর। এক কক্ষে পাটকাঠির দরজা লাগানো।

এসময় দুচোখে ছলছল জল নিয়ে তোহানের মা জাহারা খাতুন বলেন, ‘সমিতি থেকে ৫০ হাজার টাহা ঋণ নিয়ে ভ্যানডা কিনে দিছিলাম। ভ্যানডা ছিল। ভ্যান চালিয়ে তোহান প্রতিদিন দুই তিন কেজি চাল নিয়ে আসতো। কয়দিন ভ্যান নেই, টাহাও নেই। কেনাকাটা বন্ধ। আমার মা পাঁচ কেজি, ননদ দুই কেজি চাল দিছিল। এই দিয়ে চলতেছে। এহন না খেয়ে থাকলিও কেউ ১০টা টাহা দেয় না।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার একটা ভাতা কার্ড, চালের কার্ড নাই। কিস্তি এহনও শোধ হয়নি। আমার আর কিছু নেই যা দিয়ে আবার ভ্যান কিনবো। যদি মানষে সহযোগিতা করতো তাহলে একটু খায়ে পড়ে বাঁচতাম।’

তোহানরা এলাকার সবচেয়ে অসহায় ও গরিব বলে জানান যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর সদস্য রিপন আলী।

তিনি বলেন, পরিষদের পক্ষ থেকে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, লিখিত আবেদন পেলে পরিবারটির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আল-মামুন সাগর/এসআর/জেআইএম