দেশজুড়ে

কেঁচো কম্পোস্ট সার বানিয়ে রোল মডেল শিখা রানী

কেঁচো কম্পোস্ট সার বানিয়ে রোল মডেল শিখা রানী

‘নিজেদের গরুর গোবর ড্রামের মধ্যে রেখে জৈব সার তৈরি করতাম। স্বামীর অজান্তে নিজেদের ফসলের জমিতে সেই সার ছড়িয়ে দিয়ে আসতাম। যখন পাশের জমি ছাড়া আমাদের ফসলের গাছ দেখতে সবুজ ও সতেজ হতো তখন সবাই আমার স্বামীর কাছে জানতে চাইত কী বীজ ও সার ব্যবহার করে। কিন্তু আমার স্বামী তাদের বলতো, তোমরা যা দিয়েছ, আমিওতো তাই দিছি। আর আমি মুচকি মুচকি হাসতাম। কয়েকটি ফসলে এমন সফলতা আসার পর স্বামীর কাছে আমার জৈবসারের কথা প্রকাশ করি, তখন সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

Advertisement

জাগো নিউজের কাছে নিজের প্রথম সফলতার গল্প এভাবেই জানান সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষি উদ্যোক্তা শিখা রানী চক্রবর্তী। তিনি ধানদিয়া ঠাকুর পাড়া গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী মহন কুমার চক্রবর্তীর স্ত্রী।

আরও পড়ুন-

গৃহিণী থেকে দেশসেরা কৃষক সাহিদা হাতের কাজ শিখে হাজারো নারী স্বাবলম্বী চাকরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা সাইফুল, মাসে আয় ৫ লাখ

নানান প্রতিকূলতা আর চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অজপাড়া গায়ের এই নারী বর্তমানে একজন সফল ভার্মি কম্পোস্ট ও কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদনকারী উদ্যোক্তা। প্রতি মাসে তার বাড়ির আঙিনায় তৈরি খামারে প্রায় দেড়শ মণ কম্পোস্ট সার উৎপাদন হচ্ছে। একইসঙ্গে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সার উৎপাদনের সকল উপকরণ সরবরাহ করেন তিনি। তার খামারে কয়েকজন নারী শ্রমিকেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নারী উদ্যোক্তা আজ অনেকের কাছে আদর্শ।

Advertisement

শিখা রানী চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় কৃষিতে উত্তম চাষাবাদ ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি প্রথম এই জৈবসার তৈরি শুরু করেন।

তিনি বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলাবদ্ধতা ও জমির মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য এখানকার জমিতে চাষাবাদের জন্য অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এসব রোধ করার চিন্তা থেকেই এই কাজে আগ্রহী হয়েছি।

তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ভার্মি কম্পোস্ট ও কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করি। প্রথমে এই জৈবসার কেউ ব্যবহার করতে চাইতো না। পরে বেশ কয়েক বছর কৃষকদের বিনামূল্যে দিয়েছি। ভালো ফলন হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা এখন বুঝেছেন রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার অত্যন্ত কার্যকারী। বিপুল চাহিদা তৈরি হওয়ায় বর্তমানে কেজি দরে উৎপাদিত এসব সার বিক্রি হচ্ছে।

তবে উৎপাদিত কেঁচো কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট সারের ব্যাপক চাহিদার তুলনায় সার সরবরাহ করতে পারছেন না তিনি। এজন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা কামনা করেছেন।

Advertisement

শিখা রানী চক্রবর্তী বলেন, তিনি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার কেজি প্রতি ২৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। কেঁচো কম্পোস্ট ১৬ টাকা কেজি এবং তার খামারে উৎপাদিত থাইল্যান্ডের কেঁচো ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। আর কোনো কৃষক বা নারী উদ্যোক্তা খামার তৈরির জন্য আগ্রহী হলে তিনি প্রশিক্ষণ ও স্বল্পমূল্যে এসব উপকরণ বিতরণ করেন।

তিনি বলেন, বতর্মানে প্রতি মাসে খামারের সব খরচ বাদ দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এছাড়া বিভিন্ন কৃষি কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি।

জগো নিউজকে তিনি বলেন, বর্তমানে তার স্বামী মালয়েশিয়া প্রবাসী। ছেলে রাশিয়াতে একটি কোম্পানিতে কর্মরত। গ্রামে তিনি একাই বসবাস করছেন। জাতীয়ভাবে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। আগামীতে তিনি কৃষকদের কল্যাণে তার এই কাজ অব্যাহত রাখতে চান।

কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, কৃষিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিভিন্নভাবে অবদান রাখছেন। শিখা রানী তাদের একজন। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী ও কৃষিতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাড়াও উদ্যোক্তা তৈরি করতে কাজ করছেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নিরাপদ ফসল উৎপাদনে কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তা শিখা রানী চক্রবর্তী। কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তিনি ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিক অর্জন রয়েছে তার। কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে তাকে এআইপি সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

এফএ/এমএস