মশার কামড়ে ছড়ানো প্রাণঘাতী রোগ ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দিতেই প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই রোগ কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে আজ আমরা ম্যালেরিয়াকে পরাজিত করার দ্বারপ্রান্তে। তবুও প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ, বিশেষত আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠী, এখনো এই রোগের শিকার।
Advertisement
ম্যালেরিয়ার ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি, প্রতিরোধের উপায় এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-
জাগো নিউজ: বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসের গুরুত্ব কী? এ বছর এই দিবসের থিম বা বার্তা কী?
ডা. কাকলী হালদার: ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল পালিত হওয়া বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং প্রতিশ্রুতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এই বছরের বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘আমরাই করবো ম্যালেরিয়া নির্মূল: নব উদ্যমে, নব বিনিয়োগে ও নব চিন্তায়’ প্রতিপাদ্যটি ম্যালেরিয়া মোকাবেলায় ধারাবাহিক প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং এই রোগ নির্মূলের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? গত কয়েক বছরে কি প্রকোপ কমেছে?
ডা. কাকলী হালদার: গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের পরিসংখ্যান বলছে, তিন বছর আগে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে থাকলেও সর্বশেষ দুই তিন বছরে নতুন করে বাড়ছে মশাবাহিত এই রোগ সংক্রমণের সংখ্যা। বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলাকে ম্যালেরিয়া প্রবণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ঢাকাতেও ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস মশার অস্তিত্ব মিলেছে বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৩টিতেই ম্যালেরিয়া মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়ার লক্ষণ কী?
ডা. কাকলী হালদার: প্রথমদিকে কিছুসময় শীত লাগা তারপরে অল্প জ্বর, মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রার মতো উপসর্গ শুরু হয়। এরপর নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর হওয়া (১০৫-১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে) ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ। অত্যাধিক ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে বলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। এরপরে আবার জ্বর আসে। জ্বর এক দিন পর পর (নওলেসি), ২ দিন পর পর (ফ্যালসিপেরাম, ভাইভ্যাক্স, ওভ্যালি), ৩ দিন পর পর (ম্যালেরি) হতে পারে। এছাড়া এসময় প্রচণ্ড গায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, অরুচি, বমি বা বমি ভাব, তলপেট ব্যথা, ক্লান্তিভাব, খিঁচুনি, অনিদ্রা, অত্যাধিক ঘাম, রক্তশূন্যতা, যকৃত ও প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া অন্যতম। এ পর্যায়ে রোগীর দেহে জীবাণুর সংখ্যা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেলে দ্রুত রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা ভাঙতে থাকে, ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। প্লীহা ও মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
Advertisement
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়ার জটিলতা কী? কখন রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে?
ডা. কাকলী হালদার: ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার জটিলতা সবচেয়ে বেশি। রক্তের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করার ক্ষমতা অধিক বলে অন্য প্রজাতির তুলনায় অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। এমনকি মস্তিস্ক আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। ম্যালেরিয়া রোগের জটিলতম ধরন হলো ‘ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া’। প্রথমে ম্যালেরিয়ার মতো সাধারণ উপসর্গ দেখা দিলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়। দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করা না হলে মারাত্মক রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, মস্তিষ্কে প্রদাহ, কিডনির সমস্যা, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, অচেতন হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব লাল হওয়া, রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, খিঁচুনির মতো জটিলতা প্রকাশ পায় এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই রোগলক্ষণ দেখা দিলেই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অল্পবয়সী শিশু, শিশু, বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক, অ-ম্যালেরিয়া এলাকার ভ্রমণকারীরা এবং গর্ভবতী নারীরা গুরুতর রোগের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায়গুলো কী?
ডা. কাকলী হালদার: দেশে ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলার ১০০টি গ্রামের ১০ হাজার মানুষকে ম্যালেরিয়ার টিকা দেওয়ার প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে সমতল ভূমির তুলনায় পাহাড়ে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। তবে সচেতন থেকে মশার কামড় থেকে দূরে থাকতে পারলে এ রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। ঘরের আশপাশে, ফুলের টবে, খালি ড্রামে, ড্রেন, জলাবদ্ধ এলাকায় পানি জমে যেন মশা বংশবিস্তার না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে মশাবহুল স্থানে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় মশারোধী জাল এবং শরীরে প্রতিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করুন। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় ঘুরতে গেলে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ যাওয়ার আগেই শুরু করতে হবে। ভ্রমণকারীদের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য ‘এবিসিডি’ পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে: সচেতনতা, কামড় এড়ানো, উপযুক্ত ক্ষেত্রে কেমোপ্রোফিল্যাক্সিস (ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ট্যাবলেট) এবং রোগ নির্ণয়। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। সচেতন থেকে এনোফিলিস মশাকে প্রতিহত করতে পারলে ম্যালেরিয়া রোগ সম্পূর্ণরুপে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
রোগ নির্ণয় দ্রুত করতে পারলেও ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচা সম্ভব। ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে অবশ্যই যতো দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করাতে হবে। র্যাপিড এন্টিজেন টেষ্ট করে ১৫-২০ মিনিটেই শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়াও ব্লাড ফিল্ম, কালচার, পিসিআর করেও শনাক্ত করা যায়। যদি ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয় তাহলে অতিদ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে কোন অঞ্চলে ম্যালেরিয়া ঝুঁকি বেশি?
ডা. কাকলী হালদার: ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি সারা বছরই থাকে। তবে বর্ষাকালে (মে-অক্টোবর) এর সর্বোচ্চ মাত্রা থাকে। ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১৩টিতে (গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই) সংক্রমণ ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম (বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি), চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় এই ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া-প্রবণ জেলাগুলোতে ফ্যালসিপেরাম প্রজাতির ম্যালেরিয়া বেশি দেখা যায়।
ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন মাঠপর্যায়ের চিকিৎসক, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষকেরা। ১. পার্বত্য এলাকায় বিতরণ করা কীটনাশকযুক্ত মশারি মশা প্রতিরোধে সঠিকভাবে কাজ করছে না। ২. পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ বেশি হওয়ার পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে নজরদারির অভাব। ৩. প্রকৃতি, মশা ও মানুষের বিভিন্ন আচরণগত পরিবর্তন।
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়ভাবে মানুষ কী ভূমিকা রাখতে পারে?
ডা. কাকলী হালদার: সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘ম্যালেরিয়া’ নির্মূল কর্মসূচির সংশ্লিষ্টরা রোগী শনাক্ত, পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও ওষুধ বিতরণ করতে পারছে না। স্থানীয় পাহাড়ি জনগণ, জুমচাষি ও কাঠুরিয়াদের কাছে ওষুধ ও মশারি পৌঁছাতে না পারলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ম্যালেরিয়া রোগী রয়েছে। ফলে তাদের কাছ থেকেও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মাধ্যে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। আকস্মিক বন্যাও, আদিবাসীদের ভাষা, অশিক্ষা ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মীয় কুসংস্কারও ম্যালেরিয়া নিধনে বড় অন্তরায়। স্থানীয় আদিবাসীদের ধারণা ম্যালেরিয়া হলে রক্ষা নাই। এছাড়া বিভিন্ন কুসংস্কার এবং শিক্ষার অভাবে তারা ওষুধও খেতে চায়না ঠিকমতো। এমনকি মশা মারার ব্যাপারেও তাদের অনীহা আছে। আশেপাশের কয়েকটি দেশে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (ওষুধের কার্যকারিতা) ম্যালেরিয়া জীবাণু পাওয়া গেছে। ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা মূলত রোগের তীব্রতা এবং সংক্রামক মশার প্রজাতি উপর নির্ভর করে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করার পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। এখন অনেক প্রজাতি আবার ওষুধেও অকার্যকর হয়ে উঠছে। তাই স্থানীয় জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি তারা যেন মশা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়, সব নিয়ম মেনে চলে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা করে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার হয়? ঘরোয়া চিকিৎসা কি ঝুঁকিপূর্ণ?
ডা. কাকলী হালদার: আর্টেমিসিনিন কম্বিনেশন থেরাপি (এসিটিএস); জটিল ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার জন্য এই চিকিৎসা দরকার। গুরুতর ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে, ইন্ট্রাভেনাস আর্টিসুনেট ব্যাবহার করা হয়। ক্লোরোকুইন ফসফেট; ক্লোরোকুইন-সংবেদনশীল সংক্রমণের জন্য, ক্লোরোকুইন ফসফেট বা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কার্যকর থাকে।ঘরোয়া চিকিৎসা না করে দ্রুত হাসপাতাল নিতে হবে। ঘরোয়া চিকিৎসায়া এই রোগ ভালো হয়না। বরং দ্রুত জটিলতা দেখা যায়।
জাগো নিউজ: ম্যালেরিয়া নির্মূলে বাংলাদেশের সাফল্য বা চ্যালেঞ্জ কী? ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ প্রয়োজন?
ডা. কাকলী হালদার: ২০২৩ সালে ১৬ হাজার ৫৬৭ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হন। এছাড়াও ২০২৩ সালে বিদেশ ফেরত ৭৩৭ জনের ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ম্যালেরিয়া মুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। এ বছরের শেষের দিকে শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম এবং ২০২৬ সালে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ম্যালেরিয়া মুক্ত ঘোষণার পরিকল্পনা চলছে। সরকারিভাবে ২০২৭ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়াপ্রবণ জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগী প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ১-এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন সকালে খালি পেটে ফল খেলে কী হবে মাইক্রোচিটিং কি সম্পর্কের নতুন সমস্যাকেএসকে/জিকেএস