ইয়াসিন আযীয
Advertisement
খান মেহেদী মিজান একজন কবি ও সম্পাদক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। তার প্রকাশিত প্রায় সব কবিতাই আমার পড়া হয়েছে। তাই তার উপন্যাস সম্পর্কে আমার বাড়তি আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। উপন্যাসটি হাতে পাওয়ার পর ব্যস্ততার মাঝেও মাত্র আড়াই দিনে অফিসে কাজের ফাঁকে পড়ে নিয়েছি। এককথায় বলতে গেলে তার ‘ভালোবেসে অবশেষে’ উপন্যাসটি একটি ত্রিভুজ প্রেমনির্ভর কাহিনি। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছরের পুরোনো। উপন্যাসের গল্পের মতোই এর রচনাকাল কিছুটা পুরোনো বলেই আমার ধারণা। তবে বর্তমানে এসে লেখক অনেক স্থানে নতুন কিছু সংযোজন করতে চেয়েছেন। ফলে অতীত এবং বর্তমানের মাঝে অনেক স্থানে অজান্তেই মিলিয়ে ফেলেছেন।
সে বিষয়ে আলোচনার আগে উপন্যাসের শুরুটা দেখে নিই: নায়ক তার গ্রামের বাড়ি এসেছিল ইউনিভার্সিটির ছুটিতে। ছুটি শেষে রাতের ট্রেনে শেষ মুহূর্তে দৌড়ে ওঠে—ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল বলে। নায়ক যে কামরায় ওঠে—একই কামরার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল নায়িকা। নায়ক একা, নায়িকাও একা। এটা তাদের জন্য সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য—তা বিবেচনার জন্য লেখক বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। যাই হোক নায়ক-নায়িকা মুখোমুখি। তারা যেহেতু উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা। আর নায়ক-নায়িকা দেখতে কেমন হয় সকলেরই জানা। লেখকও সেভাবেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তাই তাদের শারীরিক গঠন, আকৃতি ও রূপের বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।
অনেকক্ষণ মুখোমুখি বসে থাকার পর একপর্যায়ে নায়িকাকে জিজ্ঞেস করে নায়ক—‘কী নাম তোমার? কোথায় যাবে জানতে পারি?’ নায়িকা হঠাৎ চমকে উঠে বলে—‘জ্বী আমাকে বলছেন?’ নায়ক বলে—‘আর কাকে বলব। এখানে তো অন্য কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি।’ নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাসের চিরচেনা মুখস্থ সংলাপ বাদ দিয়ে লেখক এখানে প্রথম পরিচয় ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারতেন। রুমাল দিলে ঝগড়া হয়। নায়িকা নীলা, নায়ক আকাশকে রুমাল দিতে গিয়েও—ঝগড়া হওয়ার পুরোনো প্রবাদটি তোলে। ট্রেন থেকে নামার সময় নীলা এবং আকাশের মাঝে ঠিকানা আদান-প্রদান হয়। যাতে তারা একে অপরের সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে। এর মাধ্যমেই বুঝতে পারা যায় গল্পটি পুরোনো।
Advertisement
কিন্তু আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে সদ্য এসএসসি দেওয়া একটি কিশোরী মেয়ে একা রাতের ট্রেনে কোথাও যাচ্ছে এবং ট্রেনের কামরায় মেয়েটি ছাড়া কেউ নেই—যা বাস্তবতার নিরিখে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি। বিদায়ের সময় ঠিকানা আদান-প্রদানের পাশাপাশি নীলাকে নিজের লেখা একটি কবিতার বই উপহার দেয় আকাশ। দুজনের মাঝে কিছু বিশেষ কথাবার্তা এবং কবিতার বই উপহার দেওয়ায় প্রতীয়মান হয়, প্রথম সাক্ষাতেই তাদের মাঝে ভাব বিনিময় হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের নাটকে প্রথম সাক্ষাতেই নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়ে যাওয়ার মতো উপন্যাসেও লেখক একটু তাড়াহুড়া করেছেন বলেই মনে করি।
উপন্যাসজুড়ে নায়ক আকাশ এবং নায়িকা নীলা একাধিকবার চিঠির আদান-প্রদান করেছে। যার ফলে বর্তমান সময়ের তরুণ পাঠক আগের দিনকার প্রেম, প্রেমের ধরন (হালাল প্রেমও বলতে পারি) এবং সে সময়ে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ, চিঠিতে রোমান্টিক উপমার উপস্থাপনা ভরপুর বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পাবেন। নায়ক-নায়িকা একে অপরের নিকট পাঠানো দুটি চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো: ‘আমার সকল কল্পনার স্বপ্ন সেতু তৈরী হচ্ছে। জানি না এ সেতু পার হয়ে আপনার কাছে যেতে পারবো কি না। মনে হয় এই বিশাল পৃথিবীর ওপর আপনি এক ছায়া ঘেরা আকাশ। আর আমি তার বুকে মিশে থাকা নীল। এই দুই মিলে হয়েছে (নীল+আকাশ)= নীলাকাশ।’ নায়কের কাছে নায়িকার পাঠানো চিঠিরি শেষের অংশ এটি। এবার নায়িকার কাছে নায়কের পাঠানো একটি চিঠির শুরুর অংশ দেখে নেওয়া যাক—‘লিপির শুরুতে তোমাকে জানাই আমার ব্যাকুল হৃদয়ের আকুল করা সবটুকু ভালোবাসার সুধা ও একরাশ লাল গোলাপের শুভেচ্ছা।’ এরকমই ছিল পূর্বেকার ভালোবাসার আকুতি ও আবদার।
‘ভালোবেসে অবশেষে’ নিছক রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস নয়। উপন্যাসের পরতে পরতে জীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক, নদী ভাঙনের স্মৃতি এবং জীবনের চড়াই-উৎরাই উঠে এসেছে। কয়েক বছর পূর্বের গ্রামীণ জীবনযাত্রা, জীবনের উত্থান-পতন, গ্রামের ঐতিহ্য এবং নিত্যদিনকার ব্যবহৃত বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাথে মানুষের জীবনের নিবিড় সম্পৃক্ততার বিষয়গুলোর সম্যক ধারণা দিয়েছেন লেখক। নতুন প্রজন্ম উপন্যাসটি পাঠে গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে চমৎকার ধারণা পাবে। কিন্তু বিষয়গুলো বেশিরভাগই বর্ণনামূলক। তবে এ ক্ষেত্রে বিস্তারিত বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও উপন্যাসে বিস্তারিত বলা দোষের নয়—সাহিত্যে প্রাণখুলে বলতে পারা বা লেখার প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে উপন্যাস। তবে তা যদি সংলাপনির্ভর না হয়—তবে পাঠকের কাছে বিষয়টি একঘেয়ে লাগা অস্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে নায়ক একাই শুধু বলে গেছে—নায়িকার সংলাপ খুব একটা নেই। সংলাপের মাধ্যমে বা সংলাপ আকারে প্রকাশ করা হলে—অনেক বেশি জীবন্ত মনে হতো।
উপন্যাসের লেখক একজন শিক্ষক। তাই অতীত ও বর্তমানের শিক্ষাকেন্দ্রীক বিভিন্ন বিষয় স্থান পেয়েছে উপন্যাসে। শিক্ষক হিসেবে অনেক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। দেখিয়েছেন শিক্ষকের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের অতীত ও বর্তমান সময়ের সম্পর্কের পার্থক্য। তিনি ক্লাসে যেমনি ছাত্র-ছাত্রীদের উপদেশমূলক, দিকনির্দেশনামূলক বাণী এবং নীতিবাক্য শুনিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি শুনিয়েছেন উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে। পাশাপাশি উপন্যাসে পাঠকদের অনেক বিষয়ে গাইডলাইন দিয়েছেন। যেমন কক্সবাজার ঘুরতে গেলে বা শিক্ষাসফরে গেলে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ইত্যাদি। তবে অনেক পাঠকের কাছে বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। এগুলো পাঠক উপন্যাস থেকে এভাবে শিখতে চাইবে কি না পাঠকেই ভালো জানে।
Advertisement
উপন্যাসের লেখক একজন কবি এবং নায়ক আকাশও একজন কবি—তাই বলতে পারি লেখকের নিজস্ব ছায়া রয়েছে নায়ক আকাশের মাঝে। উপন্যাসের নায়ক আকাশের মাঝে ভর করেই লেখক তার নিজস্ব জীবনদর্শন পাঠকের মাঝে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের দুই নায়িকা নীলা এবং স্বপ্না লেটার ও স্টারমার্কসহ পাস করে। আমরা জানি, এসএসসিতে ২০০১ সালে এবং এইচএসসিতে ২০০৩ সাল থেকে জিপিএ সিস্টেম চালু রয়েছে। তাই বলতে পারি, উপন্যাসের গল্প ২৫-৩০ বছরের পুরোনো এতে কোনো সন্দেহ নেই। আলোচনার প্রথমদিকে অতীত ও বর্তমানের সাথে মিলিয়ে ফেলার বিষয়টি এবং কিছু অসংগতির বিষয়ে এবার আলোচনা করা যাক:এক. চলতি ট্রেনে ঢিল ছুঁড়ে মারার বিষয়টি উঠে এসেছে উপন্যাসে। সম্প্রতি বছরগুলোতে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। পূর্বে এ রকম হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
দুই. লেখক গ্রাম্য জীবন যাত্রায় পুকুর, খাল, নদী, নালা থেকে মাছ ধরার অনেক পদ্ধতির কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে চায়না জাল বা চায়না দুয়ারি ব্যবহার করে মাছ শিকারের কথাও রয়েছে। ২৫-৩০ বছরের পুরোনো গল্পে চায়না জাল বা চায়না দুয়ারি ব্যবহারের বিষয়টি আসার কথা নয়। চায়না জাল বা চায়না দুয়ারির ব্যবহার একেবারে নতুন।
তিন নম্বর অসংগতির বিষয়ে আলোচনার আগে উপন্যাসের কাহিনিতে পুনরায় প্রবেশ করা যাক। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চিঠির মাধ্যমে। যা আমাদের নষ্টালজিক করে। আমাদের অতীতে নিয়ে যায় এবং নতুন প্রজন্মকে দেখায় যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম কিভাবে হারিয়ে গেছে কালের পরিক্রমায়। যা-ই হোক, নীলার কাছে চিঠি না পাঠিয়ে আকাশ পাঠাতো স্বপ্নার কাছে। যেন নীলার ফুফু জানতে না পারে। স্বপ্নার পরিবার ছিল নীলার ফুফুদের প্রতিবেশী। নীলার দুই বছরের সিনিয়র হলেও স্বপ্না ছিল বন্ধুর মতো। আকাশের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে স্বপ্নাকেও নিয়ে যেত নীলা। আকাশ আসতো বন্ধু শোভনকে নিয়ে। চারজন মিলে পাহাড়ের পাদদেশে আড্ডা দিতো, গল্প করতো, বাদাম খেতো। ফলে স্বপ্নার আকাশের বন্ধু শোভনকে ভালো লেগে যায়। বিষয়টি শোভনের কাছে বলার জন্য এবং আকাশকে দিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে মিল করিয়ে দিতে নীলাকে দায়িত্ব দেয় স্বপ্না। কিন্তু শোভনের বিয়ে পারিবারিকভাবে আগেই ঠিক করা আছে—আকাশ জানায় নীলাকে।
ইউনিভার্সিটির ছুটিতে বাড়ি গিয়ে শোভন শুভকাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসে। স্বপ্না বিষয়টি জানতে পেরে নীলার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। কারণ স্বপ্না ভেবেছিল নীলা ইচ্ছে করেই তার পছন্দের বিষয় শোভনকে জানায়নি। এদিকে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সময় নিকটে আসায় আকাশের প্রতি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে স্বপ্নার কাছে দিয়ে নীলা বাড়ি চলে যায়। ফলে স্বপ্না তার মনোবাসনা পূর্ণ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। তাই ইচ্ছা করেই নীলার চিরকুটটি স্বপ্না আকাশকে দেয় না। এ পর্যন্ত গল্পটা ঠিক আছে। এরপরই দেখতে পাই তৃতীয় অসংগতিটি। নীলা তার বাড়িতে যাওয়ার পরের সময়ের চিঠিগুলো এবং নীলার ভালো ফলাফলের খবর স্বপ্নার ঠিকানায় পাঠায়—এরকম হওয়ার কথা নয়। কারণ নীলা আকাশকে চিঠি পাঠাতো সরাসরি আকাশের ইউনিভার্সিটির হলের ঠিকানায়। ডাকপিয়নের কাছে আকাশ ও ওর বন্ধু শোভন মিলে নীলার চিঠির খোঁজ করতে দেখেছি। ডাকপিয়নকে আকাশকে চিঠি পৌঁছে দিতেও আমরা দেখেছি। তাই নীলার চিঠি সরাসরি আকাশের কাছেই পাঠানোর কথা—স্বপ্নার কাছে পাঠানোর কথা নয়। তবে এই সামান্য ভুলের কারণে উপন্যাসের গল্পের প্লটই বদলে যায়। ভুলটি না হলে আকাশ ও নীলার মাঝে ভুল বোঝাবুঝি যেমন হতো না। হতো না আকাশ ও স্বপ্নার মাঝে প্রেম। বান্ধবী স্বপ্নার বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রেমিক আকাশকে হারানোর বেদনায় নীলাও হেমলক পানে নীল বিষের বেদনায় হৃদয়ের বেদনাকে ভুলতে চাইতো না!
উপন্যাসের অনেক জায়গায় সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ভুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করার জন্য কিছু টাইপিং ভুল রয়েছে। আর যদি বাংলা একাডেমির সর্বশেষ বানানরীতি অনুসারে ধরি, তবে ভুলের পরিমাণ কিছুটা বাড়বে। ছোটখাটো ভুলের বিষয়টি সাধারণ পাঠকের চোখে ধরা না পড়লেও বোদ্ধা পাঠকের চোখ এড়াবে না। বর্তমানে ফেব্রুয়ারি মাস এলে তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ নিয়ে আলোচনা দেখতে পাই। উপন্যাসটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে হয়তো। তবে দ্বিতীয় সংস্করণ এলে লেখক বানানের প্রতি নজর দেবেন আশা করি।
পরিশেষে বলবো, আকাশ ও নীলার পরিচয় হয় যখন, নীলা তখন কেবল এসএসসি দিয়েছে। এরপর রেজাল্ট বের হয় প্রায় তিন মাসের মধ্যে। উপন্যাসের গল্প থাকে অনেক দীর্ঘ সময়ের। এখানে মাত্র তিন থেকে ছয় মাসের গল্প উঠে এসেছে। কিছুটা পেছনের স্মৃতি উঠে এসেছে মাত্র—যা বর্ণনামূলক। সেখানে সংলাপ নেই বললেই চলে। তাই বলতে পারি, উপন্যাসের কিছু অপ্রয়োজনীয় মেদ ছেটে ফেললে ‘ভালোবেসে অবশেষে’কে একটি বড় গল্প হিসেবেই দাঁড় করানো যায়। যেখানে লেখক জীবনের উত্থান-পতন, প্রেম-বিরহ এবং তারুণ্যের আগামীর স্বপ্ন বোনার গল্প—উপন্যাসে সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন।
খান মেহেদী মিজানের এটি প্রথম উপন্যাস। যা ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে গাঙচিল প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন সুদর্শন বাছার। ঝকঝকে ছাপা, চমৎকার প্রচ্ছদ ও বাইন্ডিং সংবলিত উপন্যাসটির মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস