খাল-বিল-নদীর জেলা বরিশালে এখন খালের সংখ্যা হাতেগোনা। স্বাধীনতার পর বরিশাল নগরীর খাল কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং দখল-দূষণে বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় এই নগরী। সিটি করপোরেশনের মর্যাদা লাভের পর ২৩ বছরেও জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর।
Advertisement
এমনকি মাত্র কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বটতলা বাজার থেকে চৌমাথা বাজার পর্যন্ত হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। শুধু এই সড়কই নয়, বৃষ্টি হলে এখনো নগরীর সদর রোড, বগুড়া রোড, কালীবাড়ি রোড, শীতলাখোলা, গোরস্থান রোড, কাউনিয়া জানুকিসিংহ রোড, ভাটিখানা, আমানতগঞ্জ, কলেজ এভিনিউ, অক্সফোর্ড মিশন রোডসহ প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যায় হাঁটুপানিতে। খালগুলো দখল ও ভরাট হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
নগরবাসী বলেন, ৫-৭ বছর আগেও এসব স্থানে এত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। এখন সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে এসব সড়ক। এর প্রধান কারণ সড়কগুলোর আশপাশের বেশ কিছু বড় বড় জলাশয় ভরাট করে সরকারি অফিস স্থাপন করা হয়েছে। অফিসগুলো স্থাপন করার পর থেকেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এগুলো দূরে কোথাও করা যেত।
খাল ও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের কারণে নগরীর এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য খোদ নগর কর্তৃপক্ষকেই দুষছেন নগরবাসী। কারণ সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খাল-পুকুর ভরাট করার নজির রয়েছে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন বরিশাল পৌরসভার মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়ই বটতলা থেকে চৌমাথা পর্যন্ত খালটি দখল করে তার ওপরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। ২০০২ সালে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। ২০০৩ সালে তৎকালীন মেয়র অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার নবগ্রাম থেকে বটতলা পর্যন্ত খাল ভরাট করে মার্কেট সম্প্রসারিত করেন। পরে ২০০৯ সালে বটতলা খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করেন মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। একইভাবে তিনি নগরীর ভাটার খালের সার্কিট হাউজের পেছনের অংশের খাল ড্রেনে রূপান্তরিত করে তার ওপর নির্মাণ করেন রাস্তা। তাছাড়া খালের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয় বক্স কালভার্ট। নগর কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকাণ্ডে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে যে যারমতো করে জলাশয় ভরাট, খাল দখল করে পরিবেশ নষ্ট করেছেন।
Advertisement
বরিশাল নগরীর চৌমাথা এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সড়কে জমে থাকা পানির কারণে ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। পানি লেগে গাড়ি বিকল হচ্ছে। বিভিন্ন সময় মোটরে পানি ঢুকে সমস্যা হয়। সারাতে পকেট থেকে টাকা গুনতে হচ্ছে।’
বটতলা এলাকার বাসিন্দা কালু বলেন, একসময় বটতলা থেকে চৌমাথা পর্যন্ত বিশাল খাল ছিল। সেই খাল ভরাট করে বক্স ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানিও ঠিকমতো নামতে পারে না। যে কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই বটতলা থেকে চৌমাথা সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। কখনো এক ঘণ্টার বৃষ্টির পানিও নামতে তিন দিন সময় লাগে।
নগরীর রূপাতলী সোহরাব হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ বাবু। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই এলাকাটি এমনিতেই একটু নিচু। তার ওপর কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই কোমরসমান পানি জমে যায়। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিরা শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর পার হলেও পানি থেকে নিস্তার মিলছে না।’
বরিশাল নগর উন্নয়ন ফোরামের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে মেয়র না থাকলেও সরকারের প্রশাসক হিসেবে একজন দায়িত্বরত আছেন। আমরা আশা রাখবো তিনি যেন নগরবাসীর ভোগান্তির কথা ভেবে জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তাহলে আমাদের আর এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে না।’
Advertisement
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল জেলা সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টিতেই বরিশালে অসহনীয় জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। জলাবদ্ধতা হওয়ার প্রধান কারণ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খাল ও পুকুরগুলো মেরে ফেলা হয়েছে। যে কয়টি খাল রয়েছে তাও সচল নয়। মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে রেখেছে। ফলে পানি নামতে পারছে না। ৫৮ বর্গকিলোমিটারের নগরীতে ৬৮ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা দরকার। কিন্তু বাস্তবে তিন ভাগের এক ভাগ ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। নগর কর্তৃপক্ষ শহরের ভারসাম্য, পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার কথা। অথচ তাদের উদ্যোগেই বিগত দিনে খাল-পুকুর ভরাট করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: পেঁয়াজের দাম যৌক্তিক নাকি বেশি? ৬ কোটির দুই পানির ট্যাংক, চালু হয়নি ৩ বছরেওকৃত্রিম জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে খালগুলো দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করা, পুকুর ভরাট বন্ধ করা, সুপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু করে তা সচল রাখা এবং যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলার পরামর্শ দেন এই পরিবেশবিদ।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন রোমেল জাগো নিউজকে জানান, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো বরাদ্দ ছিল না। তখন করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কেএফডব্লিউডি প্রজেক্টের আওতায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল খনন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ব্যবদ ১৫০ কোটি টাকার একটি কাজ চলমান।
তিনি বলেন, দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেটি অনুমোদন পেলে নগরীসহ বর্ধিত এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই জলাবদ্ধতার জন্য যে শুধু ব্যক্তি জড়িত তেমন নয়; সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরাসরি জড়িত। নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের বিপরীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভবন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, পাসপোর্ট অফিস, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড—সবগুলো ভবন জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে। ত্রিশ গোডাউন এলাকায় ক্যানসার হাসপাতালসহ নগরীর অনেক স্থানে জলাধার ভরাট করে সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মিত হচ্ছে। জলাধার ভরাট করলে পানি নেমে জমা হওয়ার কোনো স্থান পায় না। যে কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি করে।
জলাবদ্ধতার জন্য জলাশয় ভরাটকেই দুষলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বরিশাল কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী শহর। এই শহরে জলাবদ্ধতা হবে, এমনটা ভাবা যায় না। অথচ বাস্তবে জলাবদ্ধতায় নাকানি-চুবানি খাচ্ছে এই শহরের মানুষ। এর কারণ ক্যাচমেন্ট এরিয়া থেকে পানি অপসারণের সুযোগ নেই। শহরের যতগুলো জলাধার বা পুকুর ছিল তা ভরাট করে দিনে দিনে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। খাল-নালা মেরে ফেলা হয়েছে। এমনকি সচল কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে বৃষ্টিপাতে বা জোয়ারে পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী জাগো নিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে উত্তরণে নগরীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর ড্রেনের কাজ চলছে। এসব কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা দূরীকরণসহ বদলে যাবে নগরীর দৃশ্যপট।
এসআর/এএসএম