চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ী গ্রামে অবস্থিত ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদ দেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়, মসজিদটি স্থাপিত হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ ১০০৬ সালে। ঐতিহাসিক এই মসজিদে এখনো নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। তবে তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া অর্থাৎ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার প্রথম জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত মসজিদটি।
Advertisement
ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদটির নির্মাণশৈলী যে কোনো ব্যক্তিকে মুগ্ধ করবে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির স্থাপত্যশিল্প দারুণ নান্দনিক। মসজিদের চার কোণের থামের ওপর আছে চারটি ছোট মিনার। আছে দুইপাশে দুটি দরজা আর দক্ষিণ দিকে একটি জানালা এবং ছয়টি কুঠুরি। মসজিদটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে পাতলা ইট, টালি ও চুন-সুরকি। মসজিদের ভেতরের দেওয়ালে আঁকা আছে নানা ধরনের লতাপাতা ও ফুল। অবাক হলেও সত্য যে, মসজিদের গাঁথুনির সময় চুন-সুরকির সঙ্গে মেশানো হয়েছিল মসুর ডাল। মসজিদের শিলালিপিটি প্রায় নষ্ট হলেও এখনো সেটি নান্দনিক।
প্রবীণদের মতে, বাংলা ৪১৩ সনে হজরত খাইরুল বাসার ওমজ (রহ.) ইসলাম প্রচারের জন্য নদীপথে এসে ঘোলদাড়ী গ্রামে আস্তানা গড়েন এবং মসজিদটি নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি আছে, প্রথম শতাব্দির কোনো এক সময় হজরত খাইরুল বাসার ওমজ (রহ.) নদীপথে আসেন। আসার সময় ঘোলদাড়ী এলাকায় শেষ হয় নদী। সে সময় ঘোলদাড়ী এলাকায় সামান্য কিছু বাড়িঘর ছিল। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য ঘোলদাড়ী গ্রামে আস্তানা গড়েন। এখান থেকেই তিনি ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ শুরু করেন। তখন তিনি এ গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটিই ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত।
ইতিহাসবিদদের মতে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়েরও বহু আগে এ মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী যে কোনো দর্শনার্থীকেই মুগ্ধ করে। উনিশ শতকের শুরুতে ভয়াবহ আগুনে ঘোলদাড়ী গ্রাম ভস্মীভূত হলে মসজিদটি জঙ্গলে ঢেকে পড়ে। দীর্ঘ সময় পর আলমডাঙ্গা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও চুয়াডাঙ্গা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মকবুলার রহমান জঙ্গল পরিষ্কার করে নামাজ আদায়ের উপযোগী করেন। পরে সরকারি অনুদানে আংশিক সংস্কারও হয়।
Advertisement
ঘোলদাড়ী গ্রামের মৃত আ. কাদেরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী মসজিদের নামে ৮৮ শতক জমি ওয়াকফ করে দেন। তবে স্থানীয়দের দাবি, একসময় মসজিদের জমির পরিমাণ ছিল ১৪১ বিঘা। মুসল্লি নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘একসময় জায়গাটা ছিল গভীর জঙ্গল। বাঘ-ভাল্লুকও দেখা যেত। তবুও মানুষ এখানে নামাজ পড়তো।’
মসজিদটির মূল কাঠামো অনেকটা অক্ষত থাকলেও একাধিকবার সংস্কারে প্রাচীন রূপ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, যথাযথ সংরক্ষণ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মেহেদী ইসলাম বলেন, ‘ঘোলদাড়ী শাহী মসজিদটি আলমডাঙ্গার একটি ঐতিহাসিক ও মূল্যবান সম্পদ। আমরা মসজিদটির ঐতিহ্য ও স্থাপত্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। মসজিদটি এখনো স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরিচালনা হয়ে থাকে। আমি কয়েকবার গিয়েছি সেখানে। এটি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করবো।’
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মসজিদটি অনেক পুরোনো হলেও সংরক্ষণে সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় যতটুকু সম্ভব রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আমরা চাই, সরকার মসজিদটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় এনে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করুক।’
Advertisement
আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরীর ছেলে শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবা মসজিদের জন্য জমি ওয়াকফ করে গিয়েছিলেন। এটিকে আল্লাহর ঘর হিসেবে দেখে গর্ববোধ করতেন। আমরা পরিবারিকভাবে এ ঐতিহ্য লালন করি। এটি শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অমূল্য নিদর্শন।’
এসইউ/জেআইএম