দেশজুড়ে

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আরশাদ আলীর বিস্ময়কর জীবনযাপন

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আরশাদ আলীর বিস্ময়কর জীবনযাপন

দু-চোখে আলো নেই। তাই বলে অন্ধকারে হারিয়ে যাননি আরশাদ আলী। ছয় বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারালেও থেমে নেই তার জীবনযুদ্ধ। গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটা, পরিবারের কেনাকাটা ও সংসারের খুঁটিনাটি কাজকর্মসহ ব্যক্তিগত কাজ করেন স্বাভাবিক অন্যদের মতোই। চোখে দেখতে না পারলেও অন্তরের আলো দিয়েই তিনি পথ চলেন।

Advertisement

আরশাদ আলী ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানি ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা। মৃত আবুল হোসেন ও আইজান নেসা দম্পতির ছেলে তিনি।

বৈবাহিক জীবনে আরশাদ আলী এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ৯ বছর আগে তার একমাত্র মেয়েটি মারা যায়। বর্তমানে স্ত্রী, মা ও ছেলে নাতিদের নিয়ে তার সংসার।

আরশাদ আলীর মা আইজান নেসা জাগো নিউজকে জানান, ১৯৭২ সালে আরশাদ আলীর বয়স ছিল ছয় বছর। ওই বছর পুরো গ্রামে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মহামারি রোগে গ্রামের অন্তত ১৮-২০ জন মারা যান। ওই বছর বসন্তে আক্রান্ত হন আরশাদ আলী। সঠিক চিকিৎসার অভাবে তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে চোখে কিছুই দেখতে পান না তিনি।

Advertisement

পরিবারের সদস্যরা জানান, ছোটবেলায় চোখ হারানোর পরে আরশাদ আলী অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন। প্রতিনিয়ত তিনি চোট পেতেন, হয়েছেন দুর্ঘটনার শিকার। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিস্ময়কর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন তিনি। এখন নিজের ও সংসারের সব কাজ করেন নিজ হাতে।

জানা গেছে, তিনি প্রতিদিন সকালে গবাদি পশুর ঘাস কাটেন। ঘাস কাটতে চলে যান বাড়ি থেকে দূরে মাঠে। এসব কাজে তিনি কারো সহযোগিতা নেন না। সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে তিনি পথ চলেন। এছাড়া নিয়মিত বাজার, কেনাকাটা ও চাষাবাদ দেখাশোনা করেন নিজেই। তবে যারা আরশাদ আলীকে চেনেন তারা সবাই তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন।

আরশাদ আলীর প্রতিবেশীরা জানান, জীবদ্দশায় আরশাদ আলী দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার কারণে কখনো কারো কাছে হাত পাতেন না। পরিশ্রম করে চালান সংসার। একমাত্র ছেলেকে পাঠিয়েছেন প্রবাসে। বাড়ির যাবতীয় কাজ তিনি নিজ হাতে সম্পন্ন করেন। হাঁস মুরগির ঘর তৈরি, বাঁশ ও কুঞ্চি দিয়ে ঝুড়ি-কুলাসহ প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিসপত্র তৈরি করেন তিনি।

সমাজকর্মী জহির রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, আমি পেশায় রংমিস্ত্রি। আরশাদ আলীর বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হই। একজন মানুষ দুই চোখ হারিয়েও কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে পারেন, এটা আমাকে অবাক করে। আমি তার একটি ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করি। পরে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায়।

Advertisement

তিনি বলেন, আরশাদ আলীর কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানসিক শক্তির কাছে কিছুই না। দৃঢ় মনোবল ও অদম্য ইচ্ছার কারণে আরশাদ আলী নিজেই নিজের কাজ করতে শিখেছেন। তিনি চাইলেই অন্যের কাছে হাত পেতে জীবন চালাতে পারতেন। আরশাদ আলী একজন বিস্ময়কর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

আরশাদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, চোখের আলো নেই তাতে কী, আল্লাহ তো আমাকে হাত-পা দিয়েছেন, মুখ দিয়েছেন। নিজের ও পরিবারের যাবতীয় কাজ আমি নিজেই করি। মাঠে যাওয়া, গবাদি পশু প্রতিপালনসহ সব কাজ আমার আয়ত্ত হয়ে গেছে। অনুমান করে সব কাজ সঠিকভাবেই করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। কিন্তু এই ভাতা না পেলেও আমার কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমি কাজ করতে পারি। প্রতিবেশীরা আমাকে রাস্তায় চলার সময় সহযোগিতা করত। চলতে চলতে এখন সবকিছু অনুমান হয়ে গেছে। ফলে চলাফেরা করতেও কোনো সমস্যা হয় না।

জীবন নিয়ে আফসোস আছে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, জীবন নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আল্লাহ আমাকে যেভাবে পরিচালিত করেন আলহামদুলিল্লাহ, আমি তাতেই সন্তুষ্ট। তবে স্ত্রী-সন্তান ও নাতি-পুতির মুখ দেখতে না পাওয়াই মাঝেমধ্যে একটু কষ্ট লাগে। আমি মনে করি, ইচ্ছেশক্তি কাজে লাগিয়ে জীবন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। শারীরিক অক্ষমতা একটি পরীক্ষা মাত্র। চাইলেই সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। আমি সবার কাছে আমার বাকি জীবনের জন্য দোয়া চাই।

শাহজাহান নবীন/এমএন/এমএস