মতামত

সৎ ব্যক্তিকে আল্লাহ পছন্দ করেন

সৎ ব্যক্তিকে আল্লাহ পছন্দ করেন

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে। মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহপাকের ইবাদত করা, তার নির্দেশ অনুসারে জীবন পরিচালনা করা এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। অথচ আমরা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে ছুটছি ভিন্ন পথে।

Advertisement

মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য উল্লেখ করে ইরশাদ করেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৬) এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, দুনিয়ার জীবনের আসল উদ্দেশ্য হলো একমাত্র মহান আল্লাহর আনুগত্য করা এবং তার ইবাদত করা। কিন্তু আজ আমাদের মনোযোগ বাহ্যিকতা অর্জনের দিকেই বেশি। লোক দেখানো কিছু ইবাদত আর দান খয়রাত করলেও অন্তর নানান পাপে নিমজ্জিত। আমাদের কর্মময় জীবনের বেশির ভাগই চলছে অসৎভাবে, যার ফলে আজ আমাদের দু:খ কষ্ট পিছু ছাড়ছে না।

হাদিস শরিফে হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তোমাদের তিনটি বিষয় পছন্দ করেন এবং তিনটি বিষয় অপছন্দ করেন। পছন্দনীয় বিষয়গুলো হলো- একমাত্র তারই ইবাদত করবে, তার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করবে না এবং আল্লাহর রজ্জুকে মজবুতভাবে ধারণ করবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। আর অপছন্দনীয় তিনটি বিষয় হলো-অনর্থক কথা বলা, অধিক হারে প্রশ্ন করা এবং সম্পদ বিনষ্ট করা। (আবু দাউদ)

সমগ্র বিশ্ব যেন আজ অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। আমরা যদি সৎভাবে জীবন যাপনের চিন্তা-ভাবনা করতাম, তাহলে পৃথিবীতে এত অশান্তি দেখা দিত না। আমরা যদি নিজেরা সৎভাবে চলি, আর অন্যদেরকেও সৎপথে চলার নির্দেশ দিতে থাকি, তাহলেই একটি আদর্শ সমাজ ও দেশ গড়তে অনেক সহজ হয়। আমরা অনেকে ভালো উপদেশ ঠিকই দিই কিন্তু নিজেই তা পালন করি না। আমরা খুব জোর গলায় বলি কারো প্রতি অন্যায় না করা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, সবার সাথে উত্তম আচরণ করা ইত্যাদি অথচ আমার প্রতিবেশী আমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। ঘটনা যদি এমন হয়, তাহলে আপনার আমার উপদেশ কি কোনো কাজে আসতে পারে? অবশ্যই না।

Advertisement

পরিবার ও সমাজকে পরিবর্তনের জন্য যা প্রথমে প্রয়োজন তাহল নিজেকে সংশোধন করা। প্রথমে নিজেকে সমাজের একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে এবং পরিপূর্ণ সৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তারপর অন্যকে ভালো উপদেশ দিলে তা যাদুর মত কাজ করবে। সমাজে একজন সৎ ব্যক্তির সম্মান অনেক বেশি। মানবসমাজের নিরাপত্তা, প্রশান্তি, সুখ-শান্তি, বিনির্মাণ, উন্নতির ভিত্তি হল সততা। এ কারণেই সততাকে আপন করে নিতে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন করে নেয়।

অসৎকাজে নিষেধ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী। (সুরা তওবা: ১১২) চলার পথে প্রতিনিয়ত অনেক মন্দ বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে পড়ে। আমাদের উচিত হবে সাধ্যমতো সেগুলোকে প্রতিহত করা। যেভাবে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যদি খারাপ কিছু দেখ তাহলে নিজ হাতে তা দূর কর, আর তা নিজ হাতে না পারলে নিজ জিহ্বা দ্বারা একে মন্দ বলে নিষেধ কর, আর তাও যদি না পার, তাহলে মনে মনে একে ঘৃণা কর ও দোয়া কর আর এমন করাটা বিশ্বাসের দিক থেকে সর্ব নিম্নপর্যায়ের’ (মুসলিম)।

আমরা যদি সৎকাজ করতে থাকি এবং অসৎকাজ থেকে লোকদের বারণ করি, তাহলে এর পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহতায়ালা জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন: ‘যারা ইমান আনে এবং সৎকাজ করে আমরা অবশ্যই তাদেরকে এমন সব জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার পাদদেশ দিয়ে নদ নদী বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ হলো আল্লাহর প্রতিশ্রুতি আর আল্লাহর কথার চেয়ে কার কথা অধিক সত্য হতে পারে? আর পুরুষ হোক বা নারী, যে-ই মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুর বীচির ছিদ্র পরিমাণও অবিচার করা হবে না’ (সুরা নেসা, আয়াত: ১২২-১২৪)।পুরস্কার লাভের ক্ষেত্রে আল্লাহর দৃষ্টিতে নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ করা হয় নি। যে-ই ভালো কাজ করবে সে-ই তার প্রতিদান পাবে। তাই নিজ নিজ কাজ অনুযায়ী পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারেও পুরুষ ও নারীদেরকে সম-স্তরে রাখা হয়েছে। সৎকাজের জন্য নারী পুরুষ উভয়ই সমান পুরস্কার পাবে। যারা সৎ কাজ করবে, তাদের একটি সৎকাজের পরিবর্তে আল্লাহতায়ালা দশগুণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন।

যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন: ‘যে সৎকাজ করে, তার জন্য রয়েছে এর দশগুণ প্রতিদান। আর যে মন্দকাজ করে, তাকে কেবল এর সমান প্রতিফলই দেয়া হবে। আর তাদের ওপর কোন অবিচার করা হবে না’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬০)। আসলে সৎকর্ম এক উৎকৃষ্ট শস্য-বীজের মত, একটি উৎকৃষ্ট-বীজ যেমন দশগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, এমন কি আরো অধিক, তেমনিভাবে একটি সৎকাজের মাধ্যমে অনেক প্রতিদান লাভ হয়।

Advertisement

অনেকে মনে করেন, আমরা ইতোমধ্যে অনেক পাপ করে ফেলেছি, এখন কি আল্লাহতায়ালা আমাদের ক্ষমা করবেন? হ্যাঁ, আপনাদের জন্যও সুসংবাদ রয়েছে। পরে হলেও যেহেতু নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন, তাই এখন পূর্বের পাপের জন্য নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা, তওবা ও ইস্তেগফার করলে আল্লাহপাক সব পাপ ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে এই অঙ্গীকারও করতে হবে যে, আমার দ্বারা পূর্বের সেই পাপগুলো আর হবে না। যদি এমনটিই হয় তাহলে মহান আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল। তিনি বার বার ক্ষমা করেন।

যেভাবে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন: ‘তবে যে তওবা করে, ইমান আনে এবং সৎকাজ করে, তার কথা ভিন্ন। অতএব এরাই সেইসব লোক, যাদের মন্দ-কাজগুলো আল্লাহ উত্তম কাজে বদলে দিবেন। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও বার বার কৃপাকারী। আর যে ব্যক্তি তওবা করে এবং সৎকাজ করে, নিশ্চয় সে তওবা করার মাধ্যমে পুরোপুরি আল্লাহর দিকে বিনত হয়’ (সুরা ফোরকান, আয়াত: ৭০-৭১)।

তওবার অর্থ হল অনুশোচনা করা, অর্থাৎ অতীতের সমস্ত নৈতিক-ভ্রষ্টতার জন্য আন্তরিকভাবে সকল মন্দ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলার স্থির-সংকল্পের সাথে অনুতাপ করা এবং সৎকর্ম করা এবং মানুষের প্রতি কৃত সর্বপ্রকার অন্যায়ের সংশোধন করা। ব্যক্তি-জীবনে এ হচ্ছে অতীতের প্রতি সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে পূর্ণ পরিবর্তন সাধন।

আজকের জগতে চতুর্দিকে তাকালে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, নৈতিক অধঃপতনের এক চরম সীমায় আমরা বসবাস করছি। যে দিকেই তাকাই, শুধু মন্দ-কর্মই যেন ছেয়ে আছে। আজ আমরা পার্থিব জগতের মোহে আল্লাহপাকের অসন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হচ্ছি।

আল্লাহ এবং তার শ্রেষ্ঠ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন সৎ কাজে লিপ্ত থাকি। তাই আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন ও ইমানকে সংরক্ষণ করতে হলে সৎকাজ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমরা যদি সৎকাজ করি, তাহলে আমরা যেমন আল্লাহতায়ালার সুরক্ষার চাদরে আবৃত থাকবো অপর দিকে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষেরও ভালোবাসা লাভ করবো । আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সব ধরনের মন্দ কাজ পরিত্যাগ করে সৎ পথে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com

এইচআর/এমএস