• সকালে কর কর্মকর্তা পদে আবেদন, বিকেলে ভুয়া সনদে যোগদান• অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ১৩ বছর আগে চাকরিচ্যুত• একই ব্যক্তিকে পুনর্নিয়োগ দিয়েছে ডিএসসিসি
Advertisement
প্রথম শ্রেণির কর কর্মকর্তা পদে নিয়োগে সকালে আবেদন করেন তিনি। আবেদনের কয়েক ঘণ্টা পর দেন লিখিত পরীক্ষা। ঘণ্টাখানেক পর পান পরীক্ষার ফলাফল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই সাক্ষাৎকার ও নিয়োগ সম্পন্ন হয়। অথচ কর কর্মকর্তা পদে নিয়োগে ওই ব্যক্তির আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না। নিয়োগের সময় জমা দেন ভুয়া শিক্ষা সনদ।
ঘটনাটি প্রায় ১৩ বছর আগের। এ ঘটনা ঘটে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব কর্মকর্তা পদে নিয়োগে। যদিও পরবর্তীসময়ে নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ওই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল তৎকালীন প্রশাসন। এখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা দুটি মামলাও চলছে। কিন্তু এরপরও আবার ওই কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্নিয়োগ দিয়েছে ডিএসসিসির বর্তমান প্রশাসন।
আলোচিত এ কর্মকর্তার নাম হাসানুজ্জামান। তার পুনর্নিয়োগে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংস্থাটির অন্য কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত হাসানুজ্জামানকে করপোরেশনে পুনর্নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে অনিয়মকে ফের বৈধতা দিয়েছেন করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। এতে করপোরেশনে অনিয়ম-দুর্নীতি আরও বাড়বে। দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসানুজ্জামানকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
তবে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা এখনো হাসানুজ্জামানকে নিয়োগ দেননি। তার নিয়োগের বিষয়ে করপোরেশনের আইন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। যদিও করপোরেশনের সচিব স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এ অফিস আদেশের একটি কপি জাগো নিউজের কাছে আছে।
যেভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন হাসানুজ্জামান২০০৬ সালে কর কর্মকর্তা পদে সরাসরি নিয়োগের উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। তখন ওই পদে সরাসরি নিয়োগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন করপোরেশনের সাবেক উপ-কর কর্মকর্তা মো. আ. আলিম খান। ওই মামলায় কর কর্মকর্তা পদে সরাসরি নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রথমে তিন মাস এবং পরবর্তীসময়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশ বহাল রাখা হয়। মামলাটি এখনো চলমান।
আরও পড়ুন
দলবল নিয়ে অফিস করলেন ডিএসসিসির বরখাস্ত প্রকৌশলী অবৈধ সম্পদ অর্জন: স্ত্রীসহ দুদকের জালে ডিএসসিসি কর্মকর্তা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ডিএসসিসির কর্মচারী বরখাস্ত ১২ কোটি টাকা দুর্নীতির দায়ে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলী চাকরিচ্যুতএরপরও ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর মৌখিক পরীক্ষা, একই তারিখ বাছাই কমিটির সভা অনুষ্ঠান, সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, নিয়োগাদেশ জারি এবং কর্মস্থলে যোগদান দেখিয়ে হাসানুজ্জামানের নিয়োগ সম্পন্ন করে ডিএসসিসি।
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে, তখন হাসানুজ্জামান চাকরিতে আবেদনপত্রের সঙ্গে ভুয়া পে-অর্ডার জমা দেন। আবার আবেদনে উল্লেখ করেন, ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম পিকিউ (প্রি-কোয়ালিফায়েড) শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অথচ ওই শিক্ষাগত যোগ্যতার পক্ষে দেশের কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমমান সনদও দেননি। ‘পিকিউ’ বিষয়টিও রহস্যজনক। আদতে শুধু এইচএসসির সনদ দিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বনে যান।
ডিএসসিসির সূত্র জানায়, হাসানুজ্জামানের নিয়োগের সময় ডিএসসিসির মেয়র ছিলেন বিএনপির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে হাসানুজ্জামানকে চাকরিচ্যুত করেন ডিএসসিসির সাবেক প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান। চাকরিচ্যুত করার ওই অফিস আদেশে বলা হয়, হাসানুজ্জামান তদানীন্তন কর্তৃপক্ষের বেআইনি যোগসাজশে কর কর্মকর্তা পদে অবৈধভাবে কর্মরত। তাই তার নিয়োগ আদেশ বাতিল করা হলো।
হাসানুজ্জামানের নিয়োগসহ আদালতের সব কাগজপত্র যাচাই করছি। এখনো তার বিষয়ে মতামত চূড়ান্ত হয়নি। করপোরেশনের স্বার্থ রক্ষায় আইন অনুযায়ী মতামত দেওয়া হবে।- ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন
যদিও হাসানুজ্জামান চাকরিচ্যুত হওয়ার পর উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই রিটের শুনানি হয়। তখন আদালত তাকে পুনর্নিয়োগের আদেশ দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করেনি ডিএসসিসি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী উচ্চ আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান রয়েছে। এ সুযোগে হাসানুজ্জামান উচ্চ আদালতের রায়ের কপি ডিএসসিসির সচিব দপ্তরে জমা দেন।
পরে গত ৯ মার্চ কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করে হাসানুজ্জামানকে পুনর্নিয়োগের আদেশ দেন ডিএসসিসি সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা। ওই আদেশে বলা হয়, ‘হাসানুজ্জামানকে কর কর্মকর্তা হিসেবে ১৮ অক্টোবর ২০০৬ তারিখ থেকে করপোরেশনের স্থায়ী কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য করে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সাল থেকে চাকরির সব আর্থিক সুবিধা প্রদান করতঃ চাকরিতে পুনর্বহাল করা হলো।’
সচিবের এমন অফিস আদেশের পর নগর ভবনে সমালোচনা শুরু হয়। তখন হাসানুজ্জামানের পুনর্নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, তা জানতে ডিএসসিসির আইন বিভাগের মতামত চেয়েছেন মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা। আইন বিভাগ এখনো কোনো মতামত দেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির সচিব দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, হাসানুজ্জামানের পুনর্নিয়োগে আগের কোনো কাগজপত্র যাচাই করেননি সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা। তিনি মোটা অংকের টাকা নিয়ে হাসানুজ্জামানকে পুনর্নিয়োগ দিয়েছেন বলে নগর ভবনে আলোচনা হচ্ছে। এখন হাসানুজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হলে বিগত বছরের তার সব বেতন-ভাতাও দিতে হবে। এই হিসেবে ৭৫ লাখ টাকা করপোরেশনের গচ্চা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা রোববার (১২ এপ্রিল) বিকেলে জাগো নিউজকে জানান, তিনি হাসানুজ্জামানকে পুনর্নিয়োগের আদেশ দেননি এবং তার বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ মিথ্যা।
তখন হাসানুজ্জামানের পুনর্নিয়োগে ডিএসসিসির সচিব স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ কপি জাগো নিউজের কাছে রয়েছে এবং আদেশের একটি কপি তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠানো হয়েছে জানানো হলে তিনি সংযোগ কেটে দেন।
এর কিছু সময় পর তিনি হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদককে লেখেন, ‘প্রশাসকের নির্দেশনাক্রমে অর্থাৎ, ফাইলে অনুমোদনক্রমে এই পত্র জারি করা হয়েছে। পরবর্তীসময়ে সে যোগদানপত্র দাখিল করলে তার যোগদানপত্র গ্রহণ না করে এ বিষয়ে আইন বিভাগে মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
পরে জানতে চাইলে ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসানুজ্জামানের নিয়োগসহ আদালতের সব কাগজপত্র যাচাই করছি। এখনো তার বিষয়ে মতামত চূড়ান্ত হয়নি। করপোরেশনের স্বার্থ রক্ষায় আইন অনুযায়ী মতামত দেওয়া হবে।’
হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তিতে যা বলা হয়েছিলডিএসসিসির অডিট বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১২ সালে হাসানুজ্জামানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। তখন ওই অধিদপ্তর থেকে বলা হয়, তাকে অনিয়মিতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর করপোরেশনের কাছে জবাব চেয়েছে। কিন্তু করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ‘বক্তব্য সঠিক এবং মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’ তখন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়, করপোরেশনের জবাব যুক্তিসঙ্গত নয়। ওই দুই কর্মকর্তার চাকরি বাতিলসহ তাদের কাছে আপত্তি করা অর্থ আদায় করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে হাসানুজ্জামানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা দিলেও সাড়া মেলেনি।
এমএমএ/এএসএ/এমএস