• কর্মীদের ক্ষোভ নেতাদের ওপর• নেতারা প্রকাশ করছেন অসহায়ত্ব• জেলে ও দেশের বাইরে অধিকাংশ নেতা
Advertisement
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীই এখন ছন্নছাড়া। তাদের অবস্থা অনেকটা গত দেড় দশক পালিয়ে বেড়ানো বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের মতো। দলের বড় নেতাদের একাংশ দেশের বাইরে, একাংশ জেলে। কর্মী ও তৃণমূলের নেতারা এলাকাছাড়া। ঈদের কেনাকাটা দূরের কথা, ঈদগাহে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারছেন না। এমন ‘মানবেতর’ ঈদ কখনো কাটায়নি বৃহৎ এ দলটির নেতা-কর্মীরা।
সাত মাস আগেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জীবন ছিল রীতিমতো রাজকীয়। ঈদ ছিল জমজমাট। অথচ এখন তারা ফেরারি। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের জন্য এবারের ঈদ মানবেতর। নেতাদের খুঁজে পায় না কর্মীরা, খোঁজ-খবর নেয় না, এমন অভিযোগও আছে। আবার নেতারা বলছেন, সবার তো একই অবস্থা। কে কার খবর নেবে, কীভাবে নেবে?
ঈদ নিয়ে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা যা বলছেনযুবলীগ নেতা শেখ জয়নুল আবেদিন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের পর এবার প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে মানবেতর ঈদ কাটাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরিবার, বাড়িঘর আত্মীয়-স্বজন ছাড়া ঈদ হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। ইনশাআল্লাহ শেখ হাসিনা আপা যেদিন দেশে ফিরবেন, সেদিন আমরা ঈদ উদযাপন করবো।’
Advertisement
আমরাই তো আত্মগোপনে। হামলা-মামলায় জর্জরিত। ঈদ কি আর আমাদের আছে এখন? এত কষ্টের মধ্যে ঈদ কীভাবে হয়! নেতাকর্মীরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা নানাভাবে আমাদের কাছে পৌঁছায়।- নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খাইরুল আনাম চৌধুরী
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের নেতা গোলাম ফারুক রুবেল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধীরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অবাধ এ বাংলায় বিচরণ বন্ধ করেছিল। ঠিক ২০২৪ সালে একই অবস্থা বরণ করতে হচ্ছে। লাখ লাখ নেতা-কর্মী মামলা, হামলা জীবননাশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত থেকে যেদিন এদেশ রক্ষা করা যাবে সেদিনই হবে আওয়ামী লীগের জন্য ঈদ।’
আরও পড়ুন
দেড় দশক পর বিএনপির ‘ভয়হীন’ ঈদ ৭১ থেকে ২৫, বৈষম্য কি ঘুচলো? ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগে’ সায় নেই নেতাদেরলক্ষ্মীপুরের যুবলীগ নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি ঘরছাড়া, ফেরারি। এই পর্যন্ত কেউ একটা কল বা মেসেজ দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়নি। কেমন আছি, কোথায় আছি, কীভাবে চলছি। অথচ গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ করে এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, নেতা হয়ে শত শত কোটি টাকা যারা কামিয়েছে আজ তারা কেউ এই বিপদের দিনে কর্মীদের পাশে নেই।’
Advertisement
চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই কষ্ট বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। বাবা-মা না থাকলে একরকম আর অসুস্থ মাকে রেখে দূরে ঈদ করা, এটা হয়তো ঈদ বলা যাবে না। সেটা কষ্টের সমুদ্র।’
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ঝলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনাম ইয়াকুব বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন পরিবার নিয়ে। তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য অনেক কম নেতাই এগিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনাকে ছাড়া নিরানন্দ আমাদের ঈদ আনন্দ। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর আনন্দ নেই। মামলা-হামলার ভয়ে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’
একই উপজেলার ভাউকসার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ জামান মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কমবেশি সবাই কষ্টে আছে। তারপরও আমি ও আমরা যার যার সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। আশা করি আঁধার কেটে যাবে।’
আজ আওয়ামী লীগ নেই, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কোনো ঈদ আনন্দ নেই। শেখ হাসিনা নেই, দেশের মানুষের মনে শান্তি নেই। ঢাকা শহরের মানুষ আতংকের মধ্যে আছে। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামে যেতেও সাহস করছে না। শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পায়নি। ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আতংকে।-খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খাইরুল আনাম চৌধুরী (সেলিম চেয়ারম্যান) জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরাই তো আত্মগোপনে। হামলা-মামলায় জর্জরিত। ঈদ কি আর আমাদের আছে এখন? এত কষ্টের মধ্যে ঈদ কীভাবে হয়! নেতাকর্মীরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা নানাভাবে আমাদের কাছে পৌঁছায়। অনেকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারছে না। যোগাযোগটা পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। প্রত্যেকের ঘাড়ে মামলা, হামলা ও গ্রেফতারের ভয়।’
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আদর্শিক রাজনীতি করি। পৃথিবীর যিনি যে দেশে আছেন, সবাই অসামান্য নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে আছেন। ইউনূস সরকার বাংলাদেশে একটা তাণ্ডব তৈরি করেছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ধ্বংস করে দিয়েছে। এর মধ্যেও আমাদের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিল। রমজানের সংযমের মধ্য দিয়ে ফের আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ আওয়ামী লীগ নেই, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কোনো ঈদ আনন্দ নেই। শেখ হাসিনা নেই, দেশের মানুষের মনে শান্তি নেই। ঢাকা শহরের মানুষ আতংকের মধ্যে আছে। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামে যেতেও সাহস করছে না। শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পায়নি। ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আতংকে।’
অধিকাংশ নেতার জেলবন্দি ঈদআওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শীর্ষ নেতা এখন কারাগারে। এরা হলেন—আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম প্রমুখ।
দেশের বাইরে আছেন যারাদলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সুজিত রায় নন্দী, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক এমপি পংকজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন প্রমুখ।
এসইউজে/এএসএ/এমএস