উত্তরাঞ্চলের চারলেন মহাসড়ক এখন অবৈধ যানবাহনের অভয়ারণ্য। কাগজে-কলমে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু বাস্তবে সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মহাসড়কের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। দ্রুতগতির বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এসব দুর্বল যান প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। দীর্ঘ করছে দুর্ঘটনার তালিকা। ঈদ সামনে রেখে এর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।
Advertisement
পুলিশ বলছে, মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের চলাচল নেই। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো! যমুনা সেতু থেকে রংপুর, বগুড়া থেকে নাটোর, নওগাঁ হয়ে রাজশাহীর প্রতিটি রুটেই নিষিদ্ধ যানবাহনের ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি। এবার ঈদযাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে দুর্ঘটনার মূল কারণ হয়ে উঠতে পারে এই থ্রি-হুইলারগুলো।
পাশাপাশি ঈদে মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল ও স্ট্যান্ড করার কারণে এবং একমুখী পথ ও সড়কের কাজ শেষ না হওয়ার কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যানজট হওয়ার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। তারা এ ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে।
অবৈধ যানের রাজত্বউত্তরাঞ্চলের নতুন চারলেন মহাসড়কের অনেক স্থানই দখল করে আছে সিএনজিচালিত টেম্পু ও অন্যান্য থ্রি হুইলার। সংযোগ সড়কগুলোতে রয়েছে একাধিক অবৈধ স্ট্যান্ড। সেখানে এলোমেলো পার্ক করা হচ্ছে শত শত যান।
Advertisement
যাত্রীরা বলছেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ওঠা নিষিদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, শুধু বগুড়া জেলার সীমান্তে বিভিন্ন রুটে তিনশোর বেশি অটোরিকশা মহাসড়কে চলাচল করে। রয়েছে শতাধিক স্ট্যান্ড। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রামের কুন্দারহাট ও গোবিন্দগঞ্জের ফাঁসিতলায় রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের থানা ও ক্যাম্প।
অভিযোগ রয়েছে, এসব থানা ও ক্যাম্পে দায়িত্বরত কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য বিশেষ সুবিধা নিয়ে অবৈধ এসব যানবাহনকে মহাসড়কে চলাচলের সুযোগ করে দেয়। এ কারণে গোপনে নয়, বরং প্রকাশ্যে দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তারা।
আরও পড়ুন-
Advertisement
হানিফ পরিবহনের চালক আব্দুল হাই বলেন, মহাসড়কে যাতায়াতরত গাড়িগুলো দ্রুতগামী হবে, এটিই স্বাভাবিক। দেখা যায় এই দ্রুতগামী গাড়ির সঙ্গে গতির পাল্লা দেয় সিএনজি অটোরিকশাগুলো। এতে করে দুর্ঘটনা ঘটে অহরহ। অনেক সময় সিএনজি অটোরিকশার অত্যাচারে অন্য যানবাহনগুলো ধীরগতিতে চলতে গিয়ে যানজটের কবলে পড়ে।
হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলী আহমেদ হাশমী বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। অনেক সময় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মহাসড়কে থ্রি হুইলার উঠে যায়। হাইওয়ের কোনো পুলিশ সদস্য টাকা নিয়ে সহযোগিতা করছে এমন তথ্যের সত্যতা মিললে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যে কারণে মহাসড়কে নৈরাজ্যবগুড়ার শেরপুর পৌরসভায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার কোনো স্ট্যান্ড নেই। তবুও কাগজে-কলমে টার্মিনাল দেখিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ ইজারা দিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে (১ জানুয়ারি) এ টোল আদায় করছেন ইজারাদার আশেক মাহমুদ রোমান ও তার লোকজন। রশিদ দিয়েই প্রতিদিন অটোরিকশা থেকে আদায় করা হচ্ছে টাকা। শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তিন থেকে চারজন যুবক মহাসড়কে দাঁড়িয়ে ওই টাকা আদায় করেন। এরপর এগুলো চলাচল করার সুযোগ পায়।
যানবাহনের চালক ও পরিবহন মালিক সংগঠন জানায়, পৌর কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল ইজারা দেওয়ায় টাকা আদায়ের বৈধতা পেয়েছেন ইজারাদার। এতে মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে এই যানগুলো।
দেখা গেছে ইজারাদারের লোকজন জোর করেই মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর থেকে প্রতিদিন টোল আদায় করছে। এতে ব্যস্ততম মহাসড়কের ধুনট মোড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।
বাস, মিনিবাস ও কোচ পরিবহন মালিক সমিতির শেরপুর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা বলেন, পৌরসভার কোনো টার্মিনাল নেই। তবুও পৌর কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল ইজারার নামে প্রতিটি গাড়ির বিপরীতে টাকা আদায় করার সুযোগ তৈরি করেছে।
শেরপুর পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই পৌরসভার বিভিন্ন টার্মিনাল ইজারা হয়ে আসছে। তেমনি চলতি বছরও একইভাবে দরপত্রের মাধ্যমে ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নন্দীগ্রামের কুন্দারহাটে হাইওয়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি রয়েছে। আবার এই এলাকাতেই শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল হক চেইন চাঁদার নামে প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে টাকা তোলেন।
আরও পড়ুন-
গাজীপুরে নেই চিরচেনা সেই যানজট ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে স্বস্তিতে ঘরে ফিরছে মানুষ যান চলাচল নিশ্চিত ও টিকিট কালোবাজারি রোধে সেনাবাহিনীর বিশেষ টহলমোজাম্মেল হক বলেন, এটি সমিতির স্বার্থে তোলা হয়। তাকে টাকা দিলে চালকদের বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে চলাচলে কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না।
যেসব স্থান ঝুঁকিতেঈদে মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল ও স্ট্যান্ড করার কারণে এবং একমুখী পথ ও সড়কের কাজ শেষ না হওয়ার কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যানজট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। তাদের তথ্যমতো চিহ্নিত স্পটগুলোর মধ্যে যমুনা সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের গোলচত্বর, ফেন্সিগেট সংলগ্ন এলাকা, মুলিবাড়ী আন্ডারপাসের প্রবেশপথ, কড্ডা ফ্লাইওভারের পশ্চিম অংশ, কোনাবাড়ী আন্ডারপাস, হাটিকুমরুল পাঁচলিয়া বাসস্ট্যান্ড, ধোপাকান্দি ব্রিজ, হাটিকুমরুল বাজার, ঘুরকা বেলতলা, ভূঁইয়াগাতী বাসস্ট্যান্ড, সিরাজগঞ্জ বাইপাস, জমজম দইঘর, চান্দাইকোনা বগুড়া বাজার, সীমাবাড়ী কলেজ সংলগ্ন এলাকা, পেন্টাগন হোটেল, ফুড ভিলেজ হোটেল, দাদপুর জামাই রোড, জোড়া ব্রিজ এবং চান্দাইকোনা গরুর হাট, ঘোগা বটতলা, মোনায়েম কন্সট্রাকশন, ছনকা বাজার, ধুনট মোড়, শেরপুর মডেল মসজিদ এলাকা, নয়ামাইল বাজার, মাঝিরা বাজার, বনানী বাসস্ট্যান্ড, শাকপালা, তিন মাথা রেল ক্রসিং, মাটিডালি বিমানবন্দর মোড়, টিএমএসএস সংলগ্ন এলাকা, মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড, মোকামতলা বাসস্ট্যান্ড, মায়ামনি চৌরাস্তা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী পোস্ট অফিস এলাকা, পীরগঞ্জ, বড় দরগাহ্ আন্ডারপাস, শঠিবাড়ী আন্ডারপাস ও বাজার এলাকা এবং মিঠাপুকুর রয়েছে। এছাড়া ঢাকা-রাজশাহী ও ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের কাচিকাটা টোলপ্লাজা, বনপাড়া বাইপাস, বনপাড়া বাজার, বানেশ্বর বাজার তালিকার মধ্যে রয়েছে।
যমুনা সেতুর পর সিরাজগঞ্জের জোড়া ব্রিজ, হাটিকুমরুল গোলচত্বর, সনকা বাজার, বগুড়ার চান্দাইকোনা এলাকার ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। এর মধ্যে জোড়া ব্রিজ ও সনকা বাজার পয়েন্টে এক লেনে গাড়ি যাতায়াত করছে। আর বগুড়া থেকে রংপুর সড়কে গোবিন্দগঞ্জ, ধাপেরহাট, মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী এবং মর্ডান মোড়ে সবচেয়ে বেশি যানজট হয়। এই অংশেও মহাসড়কের নির্মাণ কাজ চলছে।
এছাড়া টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত চার লেন সড়কের কাজ এখনো অর্ধেকও শেষ হয়নি। ঈদের সময় স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় তিনগুণ যানবাহন চলে উত্তরের এই পথ ধরে। ফলে এখানে ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা।
পরিবহন যাত্রী ও শ্রমিকরা বলছেন, যানবাহনের ব্যাপক চাপে যমুনা সেতুতে টোল আদায় ধীরগতি এবং অনেক সময় বন্ধও হয়ে যায়। তখন সেতুর দুই পাশেই ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তি হয়।
যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), স্থানীয় প্রশাসন, জেলা পুলিশ এবং হাইওয়ে পুলিশকে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ, সড়কের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, যানবাহনের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সড়ক নির্বিঘ্ন করতে উদ্যোগঢাকা-রংপুর মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২)। এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, মার্চের মধ্যেই হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার মির্জাপুর পর্যন্ত চার লেন গাড়ি চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা চারটি আন্ডারপাস ছেড়ে দিয়েছি। এ পথে যানজট হওয়ার শঙ্কা নেই।
বগুড়া রিজিয়নের হাইওয়ে পুলিশ সুপার শহিদ উল্লাহ বলেন, নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য হাইওয়ে পুলিশ সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। এক্ষেত্রে আমরা তিনস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবো। প্রথমত, আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করবো, দ্বিতীয়ত আমাদের মোবাইল ডিউটি থাকবে এবং সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা থাকবে।
তিনি বলেন, ঈদের আগে মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলতে দেওয়া হবে না। আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবো।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রউফ বলেন, নাটোর মহাসড়কটিও বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ততম। এখন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে থ্রি হুইলারগুলো চলাচল করছে। আমরা এখন কঠোর হবো।
এফএ/এমএস