প্রায় ২১ বছর ধরে গাইবান্ধায় কর্মরত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলাম। আর এই সুযোগে তিনি ঘুস বানিজ্য করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, ঘুস ছাড়া কোনো ফাইলেই সই করতেন না ছাবিউল ইসলাম।
Advertisement
এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আরও বেপোরোয়া হয়ে পড়েন।
উপজেলা প্রকৌশলী দায়িত্বের সময় গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার অ্যাড. ফজলে রাব্বীর সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় ছাবিউল ইসলামের। এক সময় সেই সম্পর্ক পরিণীত হয় বাবা-ছেলের। ফজলে রাব্বীকে ‘ধর্মবাপ’ বানান ছাবিউল ইসলাম। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অল্প সময়েই বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। ২০২২ সালের ২২ জুলাই ফজলে রাব্বী মারা গেলেও তিনি আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকেন।
আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকতেন। তার ক্ষমতার দাপটে তটস্থ থাকতেন ঠিকাদাররা। নির্বাচনের সময় ঠিকাদারদের দিয়ে নৌকার ওয়ার্ক করে নিতেন। এছাড়া কোন ঠিকাদার ভোট সেন্টারের খরচ বহন করবেন তাও তিনি নির্ধারণ করে দিতেন।
Advertisement
সাঘাটা উপজেলার বাসিন্দা সোহাগ মিয়া বলেন, আমরা ছাবিউল ইসলামকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তেমন একটা চিনতাম না। ওনাকে আমরা ডেপুটি স্পিকারের বেটা হিসেবেই চিনতাম। ভোটের সময় উনি নিজেই ডেপুটি স্পিকারের জন্য মাঠে কাজ করতেন।
গাইবান্ধা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। তিনি রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুরে বাড়ি করেছেন। সেখানেই বসবাস করেন। ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধার সাঘাটায় যোগদান করেন। এখানে কর্মরত থাকেন ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেন টানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন।
এরপর সাঘাটা থেকে পদোন্নতি পেয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ছাবিউল ইসলাম এলজিইডি গাইবান্ধা জেলা কার্যালয়ে যোগ দেন। এই পদে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ বছর ৬ মাস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি সাঘাটা উপজেলায় (উপজেলা প্রকৌশলী) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ছাবিউল ইসলাম নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলায় যোগ দেন। সেখানে মাত্র ২৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন। তদবির করে একই সালের ৬ অক্টোবর গাইবান্ধায় বদলি নেন। পরদিন ৭ অক্টোবর তিনি গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। একই বছরের ৮ নভেম্বর তিনি পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন।
Advertisement
সাঘাটায় যোগদানের পর থেকে চলতি বছরের ২০২৫ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ২০ বছর ৯ মাস ৮ দিন গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, একজন কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে টানা তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই বিধি উপেক্ষা করে টানা প্রায় ২১ বছর ধরে এক জেলাতেই ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেন ছাবিউল ইসলাম।
সবশেষ ১৩ মার্চ রাত ২টার দিকে গাইবান্ধা থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় ছাবিউল ইসলামের গাড়ি তল্লাশি করে প্রায় ৩৭ লাখ টাকা জব্দ করে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাকে আটক করে থানায় নেয় পুলিশ। পরদিন ১৪ মার্চ বিকেলে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তার গাড়িটি সিংড়া থানা হেফাজতে আছে। জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নাটোরের সিংড়া আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান এ আদেশ দেন।
গাইবান্ধা এলজিইডির ঠিকাদাররা বলছেন, ছাবিউল ইসলাম দীর্ঘ সময় একই জেলায় থাকার কারণে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠেন। ঠিকাদাররা তার কাছে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েন। পারসোনাল কমিশন-পিসি (ঘুস) ছাড়া ফাইল সই করেন না বলে অভিযোগ করেন ঠিকাদাররা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধার এক ঠিকাদার বলেন, একই জেলায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে ওই প্রকৌশলী নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষত সব ঠিকাদাররাই তার কাছে জিম্মি ছিলেন। কমিশন ছাড়া কোনো ফাইলে সই করতেন না।
আরেক ঠিকাদার বলেন, আমরা প্রফেশনাল ঠিকাদার। তাই কোনো অফিসারের বিরুদ্ধে বললে অন্য অফিসাররা অন্য চোখে দেখবে। এমনকি টাকাও নেবে না কাজও করবে না। শুধু হয়রানি করতে থাকবে।
ঠিকাদার জুলফিকার আলী বলেন, প্রকৌশলী অফিসগুলোতে ঘুস না দিলে কোনোদিন ফাইল সই হয় না। তাই কেউ টাকা ইনভেস্ট করে হয়রানিতে পড়তে চায় না। এলজিইডিতে কাজ করতে হলে ইঞ্জিনিয়ারকে একটা অংশ দিতেই হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার ও এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ঘুস নিয়ে বিল ছাড় করা ছাড়াও তিনি সড়ক নির্মাণকাজে নিজেই পাথর, বিটুমিন, ইটের খোয়া ও রড ঠিকাদারদের কাছে সরবরাহ দিতেন।
গোলাম রব্বানী মুসা নামে স্থানীয় একজন বলেন, প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুস নেওয়াকে রীতিতে পরিণত করছেন। এসব থেকে বেড়িয়ে না এলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
এর আগে এ ঘটনায় করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তকারী কর্মকর্তা সিংড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু আহমেদ জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ চেয়ে রোববার দুপুরে আদালতে আবেদন করেন।
৩৭ লাখ টাকা জব্দের ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রাজু আহমেদ বলেন, টাকাগুলো এলজিইডির কর্মকর্তা জমি বিক্রির বলে দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তাই টাকার বৈধতা নিরূপণের জন্য তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন করেন। তদন্ত করে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ছাবিউল ইসলাম বলেন, কাজ ঠিক থাকলে বিল ছাড় করা হয়। কোনো ধরনের ঘুস নেওয়ার প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না।
গাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, তার বাবা মারা যাওয়ার পর জমি বিক্রির টাকা তার চাচা দিয়ে গেছেন। সেগুলো তিনি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন।
গাইবান্ধা নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় ঘুরেফিরে একই জায়গায় থাকেন, তার মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। এমনিতেই এক জেলায় দীর্ঘ সময় থাকা বিধি সম্মত হয়নি। তিনি সরকারি বিধি লঙ্ঘন করেছেন। ফলে এক জেলায় ঘুরেফিরে এতদিন থাকার কারণে তিনি সাহসী হয়ে ওঠেন। অনিয়ম-দুর্নীতি করার সাহস পান।
এ এইচ শামীম/জেডএইচ/এএসএম