হাসপাতালে সেবা নিশ্চিত করার চেয়ে চিকিৎসকরা ব্যস্ত পদায়ন, পদোন্নতি ও দাবিদাওয়া নিয়ে। বিভিন্ন ব্যানারে একের পর এক দাবি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বেশ চাপেই রেখেছেন তারা। কখনো কর্মবিরতির ডাক দিচ্ছে ‘বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরাম’ কখনো আন্দোলনে নামছে ‘ডক্টরস মুভমেন্ট ফর জাস্টিস’। আবার কখনো সামনে আসছেন মেডিকেলের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নরা।
Advertisement
এসব আন্দোলনের পেছনে নানান মহল নানাভাবে মদত দিচ্ছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করার পাঁয়তারা চলছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এসব বিষয়ে মুখোমুখি অবস্থানে না গিয়ে সবার সমস্যা সমাধানে নজর দিচ্ছেন তারা। যাতে চিকিৎসা খাতে সেবাটা স্বাভাবিক থাকে।
সরকারের এ অবস্থানের ফলে দীর্ঘদিন বঞ্চিত চিকিৎসকদের যৌক্তিক পদোন্নতির দাবির ফাঁকে অনৈতিক কিছু দাবিও আদায় করে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাপের মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এসবে সহমত পোষণ করছে।
সম্প্রতি বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরামের আন্দোলন ঠেকাতে তাদের সঙ্গে বসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান। এতে উভয়পক্ষ সম্মত হয় যে, ১. ঈদের আগে/পরে প্রায় চার হাজার চিকিৎসকের প্রথম ধাপে প্রমোশন হবে। ২. পছন্দক্রম থাকুক বা না থাকুক মাদার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের সাব-স্পেশালিটিতে (যে বিষয়গুলোতে ডিগ্রি নেই) প্রমোশন দেওয়া হবে। আগে পছন্দের বাইরে কোনো প্রমোশন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল এবং প্রার্থী পদ পরিবর্তনেরও সুযোগ ছিল না। ৩. ওয়ান স্টেপ প্রমোশন হবে। অর্থাৎ সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক হবেন আপাতত একবার। ৪. প্রমোশনের পর কেস টু কেস ধরে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হবে। ৫. ১৫ বছর ধরে অন্যায় সুবিধাভোগী চিকিৎসকদের যদি আবারও প্রমোশন হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সোসাইটির আপত্তির ভিত্তিতে প্রমোশন স্থগিত থাকবে।
Advertisement
চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে, সরকারের দুর্বলতার সুযোগে দুটি অনৈতিক বিষয়ে সম্মতি নিয়েছেন কিছু চিকিৎসক নেতা। এরমধ্যে সাব-স্পেশালিটিতে প্রমোশনটি অযৌক্তিক। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, যে কারও প্রমোশন হলে সোসাইটির পক্ষ থেকে আপত্তি এলে স্থগিত করা হবে। বেশিরভাগ সোসাইটিতে নির্বাচিত নেতৃত্ব নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে কমিটির নামে ড্যাবের প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছেন। দল নিরপেক্ষ বা ভিন্ন দলের কারও পদোন্নতি হলে বা সোসাইটির নেতাদের সন্তুষ্ট না করে পদোন্নতি দিলে আপত্তি দেওয়ার সুযোগ থাকছে।
দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যের পদোন্নতিতে অচলাবস্থা চলছে। এ বিষয়ে তারা কাজ করছেন। ৩৩তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতির জট কাটাতে সুপারনিউমারারি পদ সৃজনের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বিষয়গুলো দেখবেন। দলের চেয়ে যোগ্যতা প্রাধান্য দেবেন।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট সোসাইটিগুলো গড়ে ওঠে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসবের নেতৃত্ব ঠিক করার কথা থাকলেও কখনো কখনো সমঝোতা বা দখলের মাধ্যমেও নেতৃত্বে থাকেন কিছু চিকিৎসক নেতা।
Advertisement
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করছে যে, দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যের পদোন্নতিতে অচলাবস্থা চলছে। এ বিষয়ে তারা কাজ করছেন। ৩৩তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতির জট কাটাতে সুপারনিউমারারি পদ সৃজনের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমের সামনে ৮ মার্চ ঘোষণা দেন যে, আগামী ১২ সপ্তাহের মধ্যে ৭ হাজার ৫০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্য সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হবে।
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যে পুরোনো নেতৃত্ব, পদায়ন-পদোন্নতি নিয়ে অসন্তোষ ড্যাবেতিনি জানান, আগামী পাঁচ-ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রথম ফাইলের প্রমোশনের কাজ সম্পন্ন করবেন। এছাড়া পিএসসির মাধ্যমে নতুন দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলমান।
উচ্চতর ডিগ্রি প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধিউচ্চতর ডিগ্রি (এফসিপিএস, এমডি, এমএস) প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের মাসিক ভাতা দেওয়া হতো মাত্র ২৫ হাজার টাকা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ভাতা বাড়িয়ে ৩৫ হাজার টাকা করেছে। শর্ত হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে, ঢাকার বাইরে তাদের কাজ করতে হবে। সে শর্ত অনুযায়ী জানুয়ারি মাস থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এমন চিকিৎসকরা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যোগ দিয়ে প্রান্তিক মানুষদের সেবা দিচ্ছেন। এছাড়া এমন অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা দীর্ঘ সময় উপজেলা পর্যায়ে পদায়িত থেকেও বিভিন্ন অনৈতিক তদবির কিংবা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ঢাকা বা অন্য বিভাগীয় হাসপাতালে সংযুক্তিতে কাজ করতেন। সেসব সংযুক্তি অবিলম্বে বাতিল করে ওই চিকিৎসকদের পুনরায় উপজেলা পর্যায়ে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। ফলে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ সংযুক্তি বাতিল হয়েছে। ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় পর্যায়েরও সংযুক্তি বাতিল অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানা গেছে।
কেটেছে পদায়নে জটিলতাবর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতাদের জায়গায় সক্রিয় হয় বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন এনডিএফ। বদলি ও পদায়নে তাদের দাবি নিয়ে উভয় পক্ষই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ বাড়ায়। স্বাচিপের চিকিৎসকদের সরিয়ে, দীর্ঘদিন বঞ্চিত বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসকদের ঢাকায় পদায়নের দাবিতে সরব হন তারা। ফলে সরে যেতে হয় মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে, বাতিল হয় তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদায়নে ড্যাব সমর্থিত শিক্ষকরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন। শুরুর দিকে ৩৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন ড্যাব সমর্থিত ও পাঁচজন এনডিএফ সমর্থক।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ডিজি অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকেও যোগদানে বাধা দেয় ড্যাব-এনডিএফ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান ডিজি অধ্যাপক ডা. আবু জাফর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান ডিজি অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন দুজনই ড্যাব ঘরানার। দুজনই ছাত্র অবস্থায় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীসময়ে ড্যাবে সম্পৃক্ত হন। স্বাস্থ্য শিক্ষার ডিজি ডা. নাজমুল হোসেন ড্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন।
গত ২ মার্চ ৪১ জন নতুন সিভিল সার্জন পদায়ন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ৫ আগস্টের আগের সিভিল সার্জনদের ওএসডি করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, এবার পদায়নে দক্ষতা, সততা এবং জ্যেষ্ঠতা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কে ড্যাব বা এনডিএফের, এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে স্বাচিপ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলে পদায়ন হয়নি।
সরকারি হাসপাতালগুলোতেও ব্যাপক রদবদলবর্তমানে জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. হাসান জাফর, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক ডা. আবুল কেনান এবং জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. নাসির উদ্দিন ড্যাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তিনি একজন নামকরা চিকিৎসক; তবে রাজনৈতিকভাবে কোনো দলে সম্পৃক্ত নন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ড্যাব সমর্থিত ডা. মো. মাহবুব রহমান।
এনডিএফ সমর্থিতদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন এবং জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. আলফে সানি। জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক মো. সাইফউদ্দৌলা। তিনি রাজনৈতিকভাবে ড্যাব ঘরানার হলেও লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদেও পরিবর্তন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদায়নে ড্যাব সমর্থিত শিক্ষকরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন। শুরুর দিকে ৩৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন ড্যাব সমর্থিত ও পাঁচজন এনডিএফ সমর্থক। পরে সমালোচনা এলে পরবর্তীসময়ে আরও ১০ জনের পদায়নে বেশিরভাগ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোক দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, পদায়নে দক্ষতা, সততা এবং জেষ্ঠ্যতা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে ড্যাব, এনডিএফ এগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে স্বাচিপ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলে পদায়ন হয় নাই।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, আমি কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত নই। আমরা যোগ্য মানুষকে যোগ্য জায়গায় বসিয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তন করতে চাই। জুলাই আন্দোলনে শহীদরা দেশের জন্য যা চেয়েছিলেন, আমরা তার বাস্তবায়ন করতে এসেছি। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এসইউজে/এমএইচআর/এমএমএআর/জেআইএম