মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪ মার্চ কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে রঙিন এক চিত্র এঁকেছিলেন। তার মতে, আমেরিকান ড্রিম এখন আগের চেয়ে আরও বড় এবং শক্তিশালী। শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি কর্মসংস্থান রক্ষা করবেন, যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ধনী করে তুলবেন ও দেশকে সুরক্ষিত করবেন। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। বিনিয়োগকারী, ভোক্তা ও উৎপাদনকারীরা ট্রাম্পের এই অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। দেশটির অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের মতে, আক্রমণাত্মক ও অস্থির সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করে ট্রাম্প ঝুঁকির খেলায় নেমেছেন।
Advertisement
প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ট্রাম্প বিশ্বের অন্যতম সুসংহত সরবরাহ শৃঙ্খলকে বিপর্যস্ত করছেন। যদিও গাড়ির ওপর শুল্ক এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, তবুও অন্যান্য অনেক শিল্প এই নীতির ক্ষতির মুখে পড়বে।
এছাড়া, ট্রাম্প চীনের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করেছেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও হুমকি দিয়েছেন। এসব শুল্ক হয়তো কিছু সময়ের জন্য স্থগিত থাকতে পারে, আবার বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। তবে অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উভয় ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হচ্ছে যে নীতিনির্ধারণ এখন প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব উভয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।
আরও পড়ুন:
Advertisement
নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, বিনিয়োগকারী ও কর্পোরেট নেতারা ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শেয়ারবাজারে দ্রুত উত্থান ঘটেছিল, কারণ ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন যে ট্রাম্প আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাবেন এবং কর হ্রাস করবেন। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা ক্রমশ হতাশায় পরিণত হচ্ছে। শেয়ারবাজারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার হ্রাস পেয়েছে, ভোক্তা আস্থার সূচক কমেছে ও ছোট ব্যবসায়ীদের আস্থাও দুর্বল হচ্ছে। এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দার ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আমেরিকান অর্থনীতিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার প্রশাসন কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেও বাস্তবে এসব নীতি সাধারণ জনগণের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। প্রায় ১৯ লাখ আমেরিকান কৃষককে শুল্কের মাধ্যমে রক্ষা করার ফলে বাজারে খাদ্যের দাম বাড়বে, যা ৩০ কোটি ভোক্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে, আমদানি শুল্কের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অন্যান্য দেশও আমেরিকান পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করছে, যা আমেরিকান কৃষকদের রপ্তানি সংকটে ফেলছে।
এই নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ কঠিন চাপে পড়তে পারে। ফেডকে হয় উচ্চ সুদের হার বজায় রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নয়তো তা কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে ফেড খুব একটা আগ্রহী নয়, তবে পরিস্থিতি এমন থাকলে তাদের স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আরও পড়ুন:
Advertisement
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির মূল সমস্যা হলো, তার বাস্তবতাবিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর সংবিধান ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেও ২০২৪ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়া ট্রাম্প এখন ভুল শোধরানোর কোনো ইচ্ছাই দেখাচ্ছেন না। তার ভুল নীতি যে আমেরিকান অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার আগেই হয়তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। পরিস্থিতি খারাপ হলে তিনি হয়তো তার উপদেষ্টাদের বরখাস্ত করবেন, মিডিয়াকে দোষারোপ করবেন বা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী কল্পনার মাশুল গুনতে হবে আমেরিকাকেই। বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে, আর এই শুল্ক নীতিগুলো সেটিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। যদি তিনি তার ভুল স্বীকার না করেন, তবে আমেরিকার অর্থনীতির জন্য সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এসএএইচ