দেশজুড়ে

হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন কৃষকরা

রাতদিন আলু নিয়ে হিমাগারে অপেক্ষা করছেন কৃষকরা। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পরও আলু রাখতে না পেরে বিপাকে পড়ছেন। তাদের আলু নিয়ে ফেরত যেতে হচ্ছে।

Advertisement

সেহরি খেয়ে হিমাগারে আলু রাখতে যান কৃষক সাইফুল ইসলাম (৩৬)। পরের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে ফেরত যান তিনি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির মাধ্যমে ১০০ টাকা কেজি দরে আলুর বীজ ক্রয় করেছিলাম। দেড় বিঘা জমিতে আলু রোপণ করি। এতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৭০ মন আলু। হিমাগারে ১০ বস্তা আলু রাখার জন্য স্লিপ কিনি। কিন্তু স্লিপ থাকার পরও আলু হিমাগারে রাখতে না পেরে ফেরত যেতে হয়। ফলে কম দামে বাসা থেকেই আলু বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

আরেক কৃষক আব্দুল মান্নান (৬০)। একইভাবে তিনিও দেড় বিঘা জমিতে আলু রোপণ করেছিলেন। কিন্তু দুদিন হিমাগার ঘুরেও আলু রাখতে পারেননি। ফলে বাজারে বিক্রি করেছেন আলু।

Advertisement

উপজেলার শাখাহার ইউনিয়নের বাল্ল্যে গ্রামের কৃষক হেলাল সরকার এবার ছয় একর জমিতে আলু আবাদ করেছেন। আলু সংরক্ষণের বুকিং কার্ড সংকটের খবর পেয়ে কয়েকটি হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো কার্ডের ব্যবস্থা করতে পারেননি।

গত বৃহস্পতিবার সকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষিদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু রাখার বুকিং কার্ড বিক্রি করেছেন। ফলে এলাকার চাষিরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছে না। এতে আলু আবাদ করে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন। অভিযোগ আছে, হিমাগারের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় দালাল, ফড়িয়াদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসায়ীরা অগ্রিম আলু সংরক্ষণের কার্ড হাতিয়ে নেওয়ায় প্রকৃত কৃষকরা আলু সংরক্ষণ করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছেন।

জেলা কৃষি অফিস বলছে, এবার জেলায় আলুর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৪৯৭ হেক্টর জমিতে। জেলার মধ্য সবচেয়ে বেশি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ১০৪ হেক্টর জমিতে। সেখানে আলু আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৩১৮ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি জমিতে আলু আবাদ হয়েছে শুধু গোবিন্দগঞ্জে। আবহাওয়া অনুকূলে এবং রোগ বালাইয়ের আক্রমণ না থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন আলু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা গেছে, উৎপাদিত আলু সংরক্ষণের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বকচর হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজ-১, গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজ-২ ও উপজেলার সূর্যগাড়ি এলাকায় ১টি এবং সাপমারা এলাকায় এপেক্স এগ্রিসায়েন্স লিমিটেড নামে ৪টি হিমাগার রয়েছে। এছাড়া সাদুল্যাপুর উপজেলায় আরবি কোল্ড স্টোরেজ, সুন্দরগঞ্জে আশরাফ আলী কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে।

Advertisement

জেলায় ৬টি হিমাগারে ৫২ হাজার ৭৬০ টন আলু সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে কৃষকদের উৎপাদিত অধিকাংশ আলুই সংরক্ষণের বাইরে থেকে যাবে। সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে কৃষক তাদের ক্ষেতের আলু বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এতেই আলুর দাম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে লোকসানে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন কৃষকরা। বর্তমানে ৩৮০ টাকা থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা মণ দরে আলু বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে গতবছর বিদ্যুৎ বিলের অজুহাতে প্রতি বস্তা আলু রাখার ভাড়া ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা করেছিল ক্লোড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষ। এবছর ক্লোড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন কেজিতে ৮ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে। এতে ৬৫ কেজির এক বস্তা আলু রাখতে ভাড়া পড়বে ৫২০ টাকা। আর অগ্রিম বুকিং কার্ড নিতে দিতে হচ্ছে ৫০ টাকা করে। হিমাগার কর্তৃপক্ষ বলছে, গতবছর এক বস্তায় ৬৫-৬৬ কেজি পর্যন্ত আলু রাখা হয়েছিল, এবার সেটা ৫০ কেজি করে রাখতে হবে।

আলু রাখার স্লিপ কার্ড ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেওয়া শুরু করে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র তিনদিনে কার্ড দেওয়া শেষ করেছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ।

কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষ যোগসাজশ করে মজুতকারীদের আলু সংরক্ষণের কার্ড আগে দিয়ে দিয়েছে। ফলে সাধারণ কৃষকরা হিমাগারে আলু রাখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি বুকিং কার্ডের দাবিতে হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজের গেট অবরুদ্ধ করে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শত শত আলুচাষি।

হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মোজাম্মেল হক বলেন, বুকিং কার্ড শেষ হয়েছে। বিগত বছর আমাদের হিমাগারে আলু রাখা ব্যবসায়ীদের এবারও বুকিং কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সেটা পরিমাণে কম। কালোবাজারে বুকিং কার্ড বিক্রির কোনো নিয়ম নেই।

গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার সজিব বলেন, এবছর আমরা স্থানীয় কৃষকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি। মজুতদারদের কোনো কার্ড দেওয়া হচ্ছে না। কৃষকরা ৫-১০ বস্তা করে আলু নিয়ে এলে কোল্ড স্টোরেজে রাখা কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কোল্ড স্টোরেজ দুটির ধারণ ক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ বস্তা। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু বুকিং হয়েছে।

এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, কৃষকরা যাতে তাদের আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারে, সেজন্য নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। হিমাগার মালিক সমিতি আমাদের জানিয়েছে, তাদের হিমাগারগুলোতে যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা রয়েছে। কৃষকদের আলু রাখতে সমস্যা হবে না। কালো বাজারে বুকিং কার্ড বিক্রি বা কাউকে হস্তান্তর করা যাবে না। কেউ অতিরিক্ত আলু মজুতের কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, এবার আলু উৎপাদনের জন্য আবহাওয়া ভালো ছিল। তাই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে জেলায় প্রায় দেড়গুণ বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। সব কৃষকরা যাতে কমপক্ষে বীজ হিসেবে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছি। এ এইচ শামীম/জেডএইচ/এএসএম