ভ্রমণ

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশ গাছ ও তার গল্প

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশ গাছ ও তার গল্প

সানজিদা জান্নাত পিংকি

Advertisement

ফাগুনের বাতাসে উড়ে আসে বসন্তের প্রথম বার্তা। শীতের নির্জীবতার পর প্রকৃতি যখন নতুন করে প্রাণ পায়; তখন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃক্ষ যেন আগুন জ্বালিয়ে দেয় ক্যাম্পাসের বুকে। ফাগুনের বাতাসে দোল খায় লাল-কমলা ফুলের উচ্ছ্বাস। কিন্তু এই গাছের শেকড়ে শুধু মাটি নেই, আছে ভালোবাসা, স্মৃতি আর একদল স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীর ইতিহাস। তারা হয়তো জানতেন না, এটি একদিন শুধু ছায়াই দেবে না, হয়ে উঠবে সময়ের সাক্ষী, হয়ে উঠবে বসন্তের দূত।

২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর, আইন বিভাগের ৫ম ব্যাচ তখন তাদের শিক্ষাসমাপনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তবে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, তারা চেয়েছিল এমন কিছু করতে, যা কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। ঠিক সেই ভাবনাই বাস্তব রূপ পেল যখন একদল উদ্যমী শিক্ষার্থী রোপণ করল এক চিরস্মরণীয় পলাশ গাছ! তখন এটি ছিল ছোট্ট চারা গাছ, নরম ডালপালা আর স্নেহের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠার অপেক্ষায়। সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা হয়তো ক্লাস শেষে, আড্ডার ফাঁকে, অথবা কোনো বসন্ত বিকেলে এই গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কল্পনা করেছেন ভবিষ্যৎ। কেউ স্বপ্ন দেখেছেন বড় আইনজীবী হওয়ার, কেউ বিচারপতি, কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু একসময় তারা সবাই তাদের স্বপ্নপথে পা বাড়িয়েছেন, কেউ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছেন, কেউ বিদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের লাগানো গাছটি থেকে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে এক প্রহরীর মতো, নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে, পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিতে।

শীতের অবসান ঘটে যখন, চারদিকে রুক্ষ ডালপালার রাজত্ব শেষ হয়; তখন এই পলাশ গাছ ঘোষণা করে বসন্তের আগমন। শাখায় শাখায় ফুটে ওঠে উজ্জ্বল লাল-কমলা ফুল, যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা আগুনের রেখা। ক্যাম্পাসজুড়ে তখন উৎসবের আমেজ, শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে ঝলমল করে প্রাণের উচ্ছ্বাস। বসন্তের বাতাসে যখন পলাশের পাপড়ি ওড়ে, মনে হয় কোনো কবির লেখা কবিতার স্তবকগুলো আকাশের বুকে জায়গা নিচ্ছে।

Advertisement

এই গাছের নিচে বসে কত গল্প বুনেছে শিক্ষার্থীরা! কেউ বসে বই পড়েছে, কেউ মগ্ন থেকেছে বিতর্কের চর্চায়, কেউ হয়তো প্রথম প্রেমের স্বীকারোক্তি দিয়েছে এর ছায়ায় দাঁড়িয়ে। এই গাছ শুধু গাছ নয়, এটি এক অনুভূতি, এক ভালোবাসার নাম, যা যুগের পর যুগ ধরে এক ব্যাচ থেকে আরেক ব্যাচের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন কুয়াকাটা ভ্রমণে যা যা দেখবেন কম খরচে ঘুরে আসুন নীলগিরি

সময়ের স্রোতে অনেক কিছু বদলে যায়। পুরোনো ভবন নতুন রং পায়, শিক্ষকদের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হয়, পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হয়, নতুন শিক্ষার্থীরা আসে, পুরোনোরা বিদায় নেয়। কিন্তু এই গাছ বদলায় না। এটি থেকে যায় একইভাবে, তার শেকড়ে ধারণ করে রাখে সেই ৫ম ব্যাচের ছোঁয়া। এটি যেন সময়ের এক জাদুঘর, যেখানে প্রতিটি বছর বসন্তের আগুন লেগে পুরোনো দিনগুলোর ছবি ভেসে ওঠে।

ক্যাম্পাসের বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এই গাছ শুধু একটি সৌন্দর্যের উপাদান নয়, এটি তাদের পূর্বসুরীদের ভালোবাসার নিদর্শন। যারা একদিন এই গাছ লাগিয়েছিল, তারা আজ হয়তো দেশের আদালতপাড়ায় ব্যস্ত, কেউবা মানবাধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের রোপিত গাছটি থেকে যাচ্ছে, তাদের নাম-পরিচয় ছাড়াই তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

প্রতি বছর বসন্ত এলে গাছটি যেন এক নতুন প্রাণ পায়। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় তার প্রতিটি শাখা, বাতাসে ভাসে মৃদু সুগন্ধ। তখন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ভিড় জমান, ছবি তোলেন, কবিতা লেখেন, কেউবা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন এর দিকে। এটি যেন তাদের মনে করিয়ে দেয়, সময় চলে যায়, মানুষ বদলায় কিন্তু কিছু স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকে।

Advertisement

লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এএসএম