আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেবে সরকার। এখন থেকে অনুদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব সংক্রান্ত চলচ্চিত্র অগ্রাধিকার পাবে।
Advertisement
এ বিষয়ে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা, ২০২৫’ এবং ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা, ২০২৫’ করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) নীতিমালা দুটির গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
আগে ২০২০ সালের নীতিমালা অনুযায়ী পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেওয়া হতো।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালায় পরিবর্তন আনলো।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (চলচ্চিত্র অধিশাখা) মাহফুজা আখতার জাগো নিউজকে বলেন, নতুন নীতিমালার মাধ্যমে অনুদানের চলচ্চিত্রের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য দুটি ক্ষেত্রেই বাড়ানো হয়েছে। অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়ও বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘নতুন নীতিমালার মাধ্যমে এফডিসিতে স্যুটিং, ডাবিং, এডিটিং করার জন্য আমরা উৎসাহিত করছি। সেখানে (এফডিসি) কাজ করতে গেলে বলা হচ্ছিল প্রযোজক বা পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হবে। এ বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো সমিতির সদস্য হতে হবে না।’
আরও পড়ুন চলচ্চিত্রে অনুদানের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্য আহ্বান টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চেয়ে আইনি নোটিশযুগ্ম সচিব আরও বলেন, ‘কোন ধরনের চলচ্চিত্র বেশি আসবে সেই ক্রাইটেরিয়ারও আমরা নির্ধারণ করে দিয়েছি নতুন নীতিমালায়। আমরা ১৯৫২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলন বা অভ্যুত্থান নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের কথা বলেছি।’
নতুন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরে প্রাপ্ত বরাদ্দের আলোকে সর্বোচ্চ ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হবে। এরমধ্যে কমপক্ষে প্রামাণ্যচিত্র একটি, শিশুতোষ ন্যূনতম একটি; রাজনৈতিক ইতিহাস তথা আবহমান বাংলার সকল রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব যা এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিয়ামক সংক্রান্ত কমপক্ষে একটি এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস তথা বাংলার ঐতিহ্য, মিথ ও ফোকলোর সংক্রান্ত কমপক্ষে একটি চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
Advertisement
তবে কোনো অর্থবছরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও উপযুক্ত প্রস্তাব না পাওয়া গেলে সেই অর্থবছরে অনুদান দেওয়া বন্ধ বা অনুদানের সংখ্যা কমানো যাবে।
এক্ষে্ত্রে আগের নীতিমালায় বলা হয়েছিল, প্রতি অর্থবছরে প্রাপ্ত বরাদ্দের আলোকে সর্বোচ্চ ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হবে। এরমধ্যে একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে সাহিত্যনির্ভর মৌলিক গল্প ও চিত্রনাট্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
অনুদানপ্রাপ্তির জন্য মনোনীত চলচ্চিত্রের প্রযোজককে আগের মতো এখনো সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া যাবে।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে এখন থেকে প্রতি বছর ১০টির পরিবর্তে ২০টি চলচ্চিত্রকে অনুদানের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। এরমধ্যেও কমপক্ষে প্রামাণ্যচিত্র একটি, শিশুতোষ ন্যূনতম একটি; রাজনৈতিক ইতিহাস তথা আবহমান বাংলার সব রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব যা এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিয়ামক সংক্রান্ত কমপক্ষে একটি এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস তথা বাংলার ঐতিহ্য, মিথ ও ফোকলোর সংক্রান্ত কমপক্ষে একটি চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আরও পড়ুন চলচ্চিত্রে বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে তুলে ধরার আহ্বাননতুন নীতিমালা অনুযায়ী, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সরকার চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত চলচ্চিত্রের গল্প লেখককে ২ লাখ এবং চিত্রনাট্যকারকে ৩ লাখ টাকা উৎসাহ পুরস্কার দেবে। গল্পলেখক কিংবা চিত্রনাট্যকার একাধিক হলে পুরস্কারের অর্থ সমহারে বিভাজ্য হবে। উৎসাহ পুরস্কারের অর্থ গ্রহণের আগে কোনো গল্প লেখক কিংবা চিত্রনাট্যকারের মৃত্যু হলে তার বা তাদের পরিবার সে অর্থ পাবেন। আগে গল্প লেখককে ৫০ হাজার ও চিত্রনাট্যকারকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হতো।
পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়ে নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু, সংলাপ, চিত্রনাট্য সৃজনশীল ও গতিশীল হতে হবে। রাজনৈতিক ইতিহাস তথা আবহমান বাংলার সব রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব যা এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিয়ামক, বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি, লিঙ্গভিত্তিক সমতা ও মানবীয় মূল্যবোধ ধারণ করে এবং বহুস্বর বিবৃত করে এমন চলচ্চিত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে নির্মাণের সময় বাড়ানো হয়েছে। আগের নীতিমালা অনুযায়ী, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির নয় মাসের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হতো। তবে বিশেষ অবস্থায় স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনে সরকার এ সময় বাড়াতে পারতো।
নতুন নীতিমালা বলা হয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অনুদানের প্রথম কিস্তির চেক পাওয়ার পর কাহিনী চিত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৮ মাস এবং প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৪ মাসের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনে যৌক্তিক বিবেচনায় সরকার সর্বোচ্চ ছয় মাস করে দুইবার এ সময় বাড়াতে পারবে।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আগের নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম চেক পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হতো। এখন সে সময় বেড়ে ১২ মাস এবং প্রামাণ্য চিত্রের ক্ষেত্রে ১৮ মাস করা হয়েছে। তবে সরকার যৌক্তিক বিবেচনায় এ সময় তিন মাস করে সর্বোচ্চ দু’বার বাড়াতে পারবে।
অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের চিত্রায়ন, এডিটিং, ডাবিং ইত্যাদি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন এবং এর অধীন প্রতিষ্ঠানে সম্পন্ন করা যাবে। এক্ষেত্রে বিএফডিসি সার্ভিস চার্জের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রযোজক/নির্মাতা/আবেদনকারীর কোনো সমিতির সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয় বলে নতুন নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সরকারি অনুদান নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট প্রযোজকের শেষ কিস্তির অর্থ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সার্টিফিকেশন সনদ নেওয়ার পর দেশের কমপক্ষে ৫টি সিনেমা হলে মুক্তি বা কমপক্ষে ১০টি জেলা তথ্য কমপ্লেক্স/শিল্পকলা একাডেমি/পাবলিক অডিটোরিয়াম/ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন সংক্রান্ত প্রমাণক মন্ত্রণালয়ে দাখিলের পর অবশিষ্ট ১০ শতাংশ অর্থ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ বিবেচনা করে সরকার সর্বোচ্চ ৬ মাস করে সর্বোচ্চ দু’বার এ সময় বাড়াতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট প্রযোজক এ শর্ত মানতে ব্যর্থ হলে সরকার চলচ্চিত্রটি নিজ হেফাজতে গ্রহণসহ অনুদান হিসেবে প্রদেয় ১০ শতাংশ অর্থ বাজেয়াপ্তসহ দেওয়া পুরো অর্থ ব্যাংক হারে সুদসহ প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদায় করতে পারবে বলে নতুন নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আগে প্রযোজককে শেষ কিস্তি পাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে সেন্সর সনদ গ্রহণসহ দেশের কমপক্ষে দশটি সিনেমা হলে অবশ্যই মুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতো।
সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডে ডিজিটাল ফরম্যাটে একটি কপি অবশ্যই জমা দিতে হবে জানিয়ে নতুন নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সিনেমা হল মালিককে কর রেয়াতসহ অন্যান্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারবে। এ বিধান আগের নীতিমালায় ছিল না।
আরএমএম/এমএইচআর/জিকেএস