দেশজুড়ে

বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি

• এক ভবনের সঙ্গে আরেক ভবন মিশে যাচ্ছে• সরকারি রাস্তা-জায়গা দখল করেও হয়েছে অনেক ভবন• সড়ক ঘেঁষেও নির্মাণ করা হচ্ছে ভবন

Advertisement

ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সামনের ব্যস্ততম সড়কটি দিয়ে সারাক্ষণ পথচারীসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে। এই সড়ক ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে অনেকগুলো বহুতল ভবন। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিকেলে নির্মাণাধীন ১০ তলা একটি ভবনের দেওয়াল ভেঙে সড়কে পড়ে। দেওয়ালের কয়েকটি ইট এসে পড়ে চলন্ত দুটি প্রাইভেটকারের ওপর। এতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায় এবং ওপরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাগ্যক্রমে সবগুলো ইট গাড়িতে না পড়ায় প্রাণে রক্ষা পান গাড়ির চালকসহ ভেতরে থাকা লোকজন।

শহরের বিভিন্ন সড়ক ঘেঁষে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন থেকে সুড়কি কিংবা ইট-পাথর পড়ে মাঝেমধ্যেই ঘটছে এমন ঘটনা। শুধু যে ইট-পাথর পড়েই মানুষকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলছে তা নয়। নগরীরজুড়ে আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় বহুতল ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড। অনুমোদিত নকশা বদলে যায় কাজ করার সময়। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভূমিকম্প হলে এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবুও সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন। অনেক ভবনের নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায় রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছেড়ে নির্মাণ করা হয়নি অনেক ভবন। বিল্ডিং কোড না মনে তরতরিয়ে উঠছে এক ছাদের ওপর আরেক ছাদ।

Advertisement

আরও পড়ুন বিশ্বের অদ্ভুত ৮টি বহুতল অপরিকল্পিত ৮ তলা ভবনে ‘ঝুঁকি’র বসবাস

স্থানীয়রা জানান, বিল্ডিং কোডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মতো ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সরু সড়কের পাশেও হচ্ছে বহুতল ভবন। ভবন নির্মাণের সময় চতুর্দিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছাড়া হচ্ছে না। এক ভবনের সঙ্গে আরেক ভবন মিশে যাচ্ছে। সরকারি রাস্তা ও জায়গা দখল করেও হয়েছে অনেক ভবন। একজনের ভবনের ছাদের অংশ আরেকজনের জায়গায় যাওয়া নিয়েও হচ্ছে মারামারি।

বেশিরভাগ বহুতল ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এভাবে নগরীজুড়ে বহুতল ভবন নির্মাণের মচ্ছব চললেও জোড়ালো অভিযান চালিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করছে না সিটি করপোরেশন।

নগরীর জেল রোডে সাইফুল ফিলিং স্টেশন ঘেঁষে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। ফিলিং স্টেশনের মালিক সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের পাম্প ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবনটি। আমার অফিস ঘেঁষে ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। চারপাশে যতটুকু জায়গা ছেড়ে নির্মাণ করা উচিত, তাও মানা হয়নি। সিগারেটের আগুন পাম্পে পড়লে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনে অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছি।’

নগরীর কালিঝুলি এলাকার বাসিন্দা সুমন মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার হাফ বিল্ডিং বাসা। আমার পাশের জমির মালিক আমার বাসা ঘেঁষে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। চারপাশে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গাও ছাড়া হয়নি। এ কারণে আমার বাসার দেওয়ালগুলো ফেটে গেছে। যে কোনো সময় দেওয়াল ভেঙে পড়লে আমাদের নির্ঘাত মৃত্যু। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা আসেনি। এখন ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন মুহূর্তেই ধ্বংস হয়েছে বিশ্বের যেসব বহুতল ভবন সরু গলিতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, নেই অগ্নিনিরাপত্তা: আইপিডি

সিটি করপোরেশন বলছে, নগরীর ৭২ হাজার ৬২১টি হোল্ডিংয়ে লক্ষাধিক ভবন রয়েছে। এরমধ্যে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর অন্তত দেড় হাজারের বেশি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নগরীতে গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক সাততলার চেয়ে বড় ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বিল্ডিং কোড না মানায় ৬০টি ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ। বিল্ডিং কোড লঙ্ঘনের বিষয়টি জানতে পারলে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন।

অনুমোদিত নকশা বদলে ভবন নির্মাণ করায় ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ রেইন কিল্ডার্সের পরিচালক প্রকৌশলী নাদিম পারভেজ খান।

তিনি বলেন, ‘অনেকে পাঁচতলার ফাউন্ডেশন দিয়ে আটতলা নির্মাণ করছেন। অনেকে অনুমোদিত নকশা বদলে ভবন নির্মাণ করছেন। বিল্ডিং কোডকে তোয়াক্কা না করে চারপাশে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গাও ছাড়া হচ্ছে না। এভাবে ভবন নির্মাণ হওয়ায় নগরবাসী ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। নকশাবর্হিভূতভাবে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর কাজ এখনই থামিয়ে দেওয়া উচিত।’

আরও পড়ুন বিশ্বের সর্বোচ্চ বহুতল ভবনের তকমা খোয়াচ্ছে বুর্জ খলিফা ভবন নির্মাণে কী কী ছাড়পত্র লাগে?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, ‘সময় যত যাচ্ছে বহুতল ভবন নির্মাণও বাড়ছে। গত কয়েকবছরের ব্যবধানে অলিগলিতে ও সরু সড়কের পাশে অসংখ্য বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। পুকুর ভরাট করেও ভবন নির্মাণ হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হওয়া ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্যোগে কাজ করতে এটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) নগর পরিকল্পনাবিদ মানস কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘যেসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লেআউট প্ল্যানের ব্যত্যয় করা হয়েছে, সেগুলো আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী ভেঙে দিয়েছি। নির্মাণ হচ্ছে এমন ভবনগুলোও পরিদর্শন করছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা। বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণ হচ্ছে জানতে পারলে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেবে। এক্ষেত্রে নগরবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন।’

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সুমনা আল মজীদ বলেন, বিল্ডিং কোড না মানার কারণে ভবন মালিকসহ তাদের পরিবার যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে, ঠিক তেমনি নগরবাসীও ঝুঁকিতে পড়ছে। তাই ভবন নির্মাণের আগে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ করলে নির্মাণকাজ বন্ধ করা হবে।

এসআর/জিকেএস