আরিফুল ইসলাম তামিম
Advertisement
কক্সবাজারের নাজিরারটেক দেশের অন্য সমুদ্রসৈকতের তুলনায় একেবারেই আলাদা। জেলেদের জীবনসংগ্রাম, শুঁটকি তৈরির প্রক্রিয়া এবং কর্মজীবনের নানা গল্পের দেখা মেলে এখানে। ভোরের আলো ফুটতেই সৈকতপাড়ে শুরু হয় কর্মব্যস্ততা। জেলেদের দিন শুরু হয় সমুদ্র থেকে মাছ নামানো, ঠেলাগাড়িতে মাছ আনা-নেওয়া, বরফের জোগান দেওয়াসহ নানা কাজে।
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিপল্লিটি প্রায় ১০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। নাজিরারটেক এলাকায় পৌঁছানোর ১ কিলোমিটার আগ থেকেই শুঁটকির ঘ্রাণ অনুভূত হয়। সড়কের একপাশে প্রায় ১ কিলোমিটারজুড়ে শুঁটকি তৈরি হয়। জেলেদের জালে ধরা পড়া মাছ বাঁশের মাচায় ঝুলিয়ে শুকানো হয়।
প্রায় ১৫-২০ হাজার জেলে পরিবার এ অঞ্চলের মাছ ধরা ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের কাজে নিয়োজিত। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে শুঁটকি তৈরি। প্রতিদিন সমুদ্র থেকে ট্রলার ও নৌকাভর্তি মাছ আসে। রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, লইট্যা, চিংড়িসহ প্রায় ২০-২৫ প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। এসব মাছ ঠেলাগাড়িতে করে শুঁটকিপল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাছ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার পরপরই বরফে সংরক্ষণ করা হয়।
Advertisement
নাজিরারটেকে জেলেদের কর্মব্যস্ততা সৈকতের সৌন্দর্যকে আরও জীবন্ত করে তোলে। সারি সারি ট্রলার, নীল জলরাশির ওপর সূর্যের সোনালি আলো, গাঙচিলের ওড়াউড়ি যেন এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। প্রতিটি ট্রলার ২-৩ দিন থেকে শুরু করে ৮-১০ দিন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। শীত-বর্ষা সব ঋতুতেই মাছ ধরার কাজ চলে। তবে বর্ষায় শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ থাকে।
আরও পড়ুনবিষমুক্ত শুঁটকির আধুনিক পদ্ধতি ও চেনার কৌশল২৩০ নদ-নদী: উদ্ধারের এখনই সময়বিকেল হলেই গান আর গল্পে মেতে ওঠেন জেলেরা। চট্টগ্রামের ভাষায় বিভিন্ন গান গেয়ে কাজ করতে থাকেন। বাউল, ভাটিয়ালিসহ চাটগাঁইয়া লোকজ গানে মুখরিত হয়ে ওঠে সমুদ্রের পাড়। কথা হয় স্থানীয় জেলে শুক্কুর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো ২-৩ দিন, আবার কখনো ৮-১০ দিনের জন্য মাছ ধরতে যাই। মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যেতে হয়। বেশিরভাগ সময় লাক্ষা, পোয়া, ছুরি, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। এসব মাছ নিয়ে আসার পর পরিষ্কার করে শুঁটকি করা হয়। এই শুঁটকি দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়।’
শুক্কুর আলী বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। শীত মৌসুমেই মূলত শুঁটকি তৈরি হয়। প্রতিদিন ২ কোটি, আবার কখনো ৩-৪ কোটি টাকার শুঁটকি বাণিজ্য হয় এখানে। প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমজীবী জেলে মাছ ধরা ও শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত। ছুরি শুঁটকি হতে সময় লাগে ২-৩ দিন। এ ছাড়া বড় মাছের শুঁটকি তৈরি হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগে। বর্ষায় শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ থাকে, তবে তখন মাছ ধরে সেগুলো বিক্রি করা হয়।’
শুঁটকিপল্লির নারী শ্রমিক শিউলি বলেন, ‘পুরুষদের পাশাপাশি আমরাও সকাল থেকে কাজ করি। মাছ পরিষ্কার করে মাচায় শুকাতে দিই, আবার পাহারা দিই। যাতে পোকামাকড় বা কাক ক্ষতি না করে।’
Advertisement
এখানকার কর্মযজ্ঞ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদিও নাজিরারটেকে পর্যটকের আনাগোনা খুব বেশি নয়। তবুও যারা আসেন; তারা কৌতূহল থেকে জেলেদের জীবন, শুঁটকি উৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং সমুদ্রপাড়ের ব্যস্ততা দেখেন। নাজিরারটেক যেন সমুদ্রের ঢেউ আর মানুষের ঘামে ভেজা এক জীবন্ত গল্প—যেখানে মেলে সংগ্রামের সৌন্দর্য আর শুঁটকির ঘ্রাণে মিশে থাকা জীবনের অন্যরকম স্বাদ।
লেখক: চতুর্থ বর্ষ, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।
এসইউ/জেআইএম