• আমদানি করা ঢাকাগামী পণ্য আটকে আছে চট্টগ্রামে• এক মাস ধরে চলা সংকট সমাধানে পদক্ষেপ নেই রেলওয়ের• পানগাঁও এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস নিতে কাস্টমসের অনুমতি• সংকট কাটছে না দুই বছরের আগে
Advertisement
ইঞ্জিন সংকটে আমদানি করা পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনে তৈরি হয়েছে লেজেগোবরে অবস্থা। ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) কনটেইনার পরিবহনে তৈরি হয়েছে সংকট। এতে নির্ধারিত সময়ে আমদানি-রপ্তানির পণ্য কমলাপুর আইসিডি ও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে আইসিডিগামী আমদানি পণ্যভর্তি প্রায় দুই হাজার কনটেইনার আটকা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।শিপিং এজেন্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আইসিডিগামী কনটেইনার বন্দরে আটকে থাকায় বন্দরের অতিরিক্ত স্টোর রেন্ট আরোপের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে শিপিং এবং ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ব্যবসাও। মূলত রেলের পণ্য পরিবহনের জন্য নির্ধারিত ইঞ্জিনগুলো সরিয়ে নেওয়ায় বন্দর থেকে কনটেইনারবাহী ট্রেনের জন্য ইঞ্জিনের সংকট তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেশিরভাগ কনটেইনার সড়কপথে আনা-নেওয়া করা হয়। তিন-চার শতাংশ কনটেইনার আনা-নেওয়া হয় রেল ও নৌপথে। ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে ট্রেনের মাধ্যমে কনটেইনারবাহী পণ্য আনা-নেওয়া হয়। প্রতিদিন আইসিডিতে পরিবহন করা হয় ১০০ থেকে ১২০টি কনটেইনার।
Advertisement
আইসিডিগামী কনটেইনার পরিবহনের জন্য রেলওয়ের সঙ্গে বন্দরের সমঝোতা চুক্তি রয়েছে। এসব কনটেইনার কমলাপুর আইসিডি যাওয়া পর্যন্ত শিপিং এজেন্ট কিংবা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্সদের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব কনটেইনারের পণ্য কমলাপুর আইসিডি থেকে খালাস নেন আমদানিকারকরা।- বাফা ডাইরেক্টর ইনচার্জ দোলন বড়ুয়া
কিন্তু ইঞ্জিন সংকটের কারণে গত এক মাসে নিয়মিত সময়ের চেয়ে তিনগুণ কনটেইনার বন্দর এবং হালিশহরের চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ডে (সিজিপিওয়াই) প্রায় আড়াই হাজারের মতো কনটেইনার আটকে যায়। এর মধ্যে সিজিপিওয়াইতে ছয়টি রেখে কমপক্ষে ৩৬০ টিইইউএস কনটেইনার এবং বন্দর অভ্যন্তরে দুই হাজারের মতো কনটেইনার আটকা পড়েছে।
সিজিপিওয়াইয়ের প্রধান ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘লোকো (ইঞ্জিন) সংকটের কারণে আমাদের ইয়ার্ডে কনটেইনার, খাদ্যশস্য ও জ্বালানিবাহী রেক আটকা আছে। এর মধ্যে বর্তমানে কনটেইনারের ছয়টি রেক রেডি রয়েছে। দুটি ইঞ্জিন পাওয়া গেছে। একটি বিকেল সাড়ে ৫টায় ছেড়ে গেছে। অন্যটি রাত সাড়ে ১১টায় ছেড়ে যাবে।’
নিয়মিত আমদানিপণ্য সরবরাহ না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছে ঢাকাসহ আশপাশের আমদানিকারকরা। আবার রমজান সামনে রেখে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করা ব্যবসায়ীরাও পড়ছেন ক্ষতির মুখে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) ডাইরেক্টর ইনচার্জ (পোর্ট অ্যান্ড কাস্টমস) দোলন বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইসিডিগামী কনটেইনার পরিবহনের জন্য রেলওয়ের সঙ্গে বন্দরের সমঝোতা চুক্তি রয়েছে। এসব কনটেইনার কমলাপুর আইসিডি যাওয়া পর্যন্ত শিপিং এজেন্ট কিংবা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্সদের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব কনটেইনারের পণ্য কমলাপুর আইসিডি থেকে খালাস নেন আমদানিকারকরা।’
Advertisement
‘এখন রেলওয়ের ইঞ্জিন সংকটের কারণে যেসব কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে রয়েছে, সেগুলোতে ফ্রি-টাইমের পরে চারগুণ হারে স্টোর রেন্ট আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখানে তো শিপিং এজেন্টদের কোনো দোষ নেই। তাতে অতিরিক্ত ট্যারিফ চাপিয়ে দিলে নতুন করে সংকট তৈরি হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে যাওয়া আইসিডিগামী কনটেইনারের পণ্য বিকল্প পন্থায় পানগাঁও এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি খালাস নেওয়ার জন্য কাস্টমস থেকে ইতোমধ্যে একটি অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমদানিকারকরা চাইলে সেই সুবিধা নিয়ে পণ্য খালাস নিতে পারেন।- চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক
দোলন বড়ুয়া বলেন, ‘পণ্য দ্রুত খালাস হলে কনটেইনারও দ্রুত খালি হয়। এখন কনটেইনার বন্দরে আটকা থাকার কারণে একদিকে শিপিং এজেন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস নিতে না পেরে আমদানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে এখানে শিল্পের মেশিনারিজ, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজসহ কমার্শিয়াল আইটেম থাকে।’
আরও পড়ুন ঢাকায় কনটেইনার ট্রেনের চাপ কমাতে ধীরাশ্রমে আইসিডি নির্মাণ বন্দরে কনটেইনার জট, পরিচালনায়ও জটিলতা বন্দরে ফের কনটেইনার-জাহাজ জট, পানগাঁওয়ে পণ্য খালাসের উদ্যোগবন্দরে আটকে যাওয়া আইসিডিগামী পণ্য পানগাঁও কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও খালাসের সুযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘোষণা বন্দর কর্তৃপক্ষ আগেও দিয়েছিল। কিন্তু আমদানিকারকরা পানগাঁও যেতে উৎসাহী নন।’
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে ৪০ হাজার ৫৪৩ টিইইউএস কনটেইনার রয়েছে, যা স্বাভাবিক সময়ে ৩৬ থেকে ৩৮ হাজার টিইইউএসের মতো থাকে। এক মাস আগে ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ছিল ৩৭ হাজার ২৫১ টিইইউএস।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেলওয়ের ইঞ্জিন সংকট রয়েছে। এতে কমলাপুর আইসিডিগামী অন্তত দুই হাজার কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে। এমনিতে আইসিডিগামী ৮শ কনটেইনার রাখার সুযোগ রয়েছে বন্দরে। আইসিডিগামী কনটেইনারের কারণে বন্দরের অপারেশনে প্রভাব পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আমরা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। রেলওয়ে তাদের নিয়মিত প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর শিডিউল ঠিক রাখার জন্য কনটেইনার কিংবা অন্য গুডস ট্রেনের ইঞ্জিন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে। তারপরেও বন্দরের কনটেইনারের চাপ কমানোর জন্য তারা (রেলওয়ে) ইঞ্জিন সরবরাহ বাড়াচ্ছে। এখন প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ইঞ্জিন দেওয়া হচ্ছে।’
ইঞ্জিনের সাময়িক সংকট কাটাতে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় কিছু ইঞ্জিন মেরামত করা হচ্ছে। যাতে রমজান সামনে রেখে ক্রাইসিস ম্যানেজ করা যায়। সে হিসেবে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহনের অগ্রাধিকার দিয়ে ইঞ্জিন সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন কিনতে আরও এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে।- চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান
বন্দর সচিব বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে যাওয়া আইসিডিগামী কনটেইনারের পণ্য বিকল্প পন্থায় পানগাঁও এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি খালাস নেওয়ার জন্য কাস্টমস থেকে ইতোমধ্যে একটি অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমদানিকারকরা চাইলে সেই সুবিধা নিয়ে পণ্য খালাস নিতে পারেন।’
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেনে খাদ্যশস্য ও জ্বালানি পরিবহন করা হয়। পাশাপাশি কমলাপুর আইসিডিতে আমদানিপণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহন করা হয়। এতে প্রতিদিন গড়ে ১৩টি ইঞ্জিন প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু বাস্তবে ইঞ্জিন পাওয়া যাচ্ছে ৫-৬টি। এসব ইঞ্জিন দিয়ে কনটেইনার, চাল এবং জ্বালানি তেলবাহী ট্রেন চালাতে হয়।
ইঞ্জিন সংকটের কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেলের নতুন নতুন রুট বেড়েছে। কিন্তু গত দু-এক বছরে নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়নি। আবার কিছু ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে। এতেই ইঞ্জিনের সংকট তৈরি হয়েছে। যাত্রী পরিবহন স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ইঞ্জিন সরবরাহ দিতে হচ্ছে। যে কারণে কনটেইনারসহ গুডস ট্রেনের ইঞ্জিন সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনের সাময়িক সংকট কাটাতে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় কিছু ইঞ্জিন মেরামত করা হচ্ছে। যাতে রমজান সামনে রেখে ক্রাইসিস ম্যানেজ করা যায়। সে হিসেবে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহনের অগ্রাধিকার দিয়ে ইঞ্জিন সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন কিনতে আরও এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম