দেশজুড়ে

হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা

• মাতৃভাষার পাঠ্যবই নেই, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকও• শেরপুরের ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী এখনো স্কুলের বাইরে

Advertisement

জীবন কৃষ্ণ হাজং। শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি পল্লির বাসিন্দা। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন হাজং ভাষার লোকগান, লোককথা। সেই ভাষাই ছিল তার শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তার দুই সন্তান সেই ভাষা বোঝে না। বাড়িতে হাজং ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলেও সন্তানরা জবাব দেয় বাংলায়।

জীবন কৃষ্ণের আক্ষেপ- ‘আমি যদি আমার সন্তানদের সঙ্গেই নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারি, তাহলে আমার ভাষার ভবিষ্যৎ কী?’

শুধু জীবন কৃষ্ণ হাজং নন, শেরপুরের প্রায় ২১ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ একই বাস্তবতার মুখোমুখি। গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, মাহালী, ম্রোসহ ১৬টির বেশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় এখানে বসবাস করলেও তাদের মাতৃভাষার পাঠ্যবই নেই, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকও। ফলে শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি।

Advertisement

আরও পড়ুন-

পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দ রাখা রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দ্রুত সরানোর দাবি ‘মাতৃভাষা’য় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর দাবি আদিবাসীদের

নালিতাবাড়ীর কল্পনা রানী হাজংও একসময় মাতৃভাষায় কথা বলতেন, কিন্তু সন্তানদের শুধু বাংলা শেখাচ্ছেন। কারণ মাতৃভাষায় কথা বলার কারণে বিভিন্ন জায়গায় তাকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। সরকারি অফিস, ব্যাংক কিংবা বাজারে গেলেও ভাষাগত কারণে তাকে অপমান সহ্য করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, একবার ব্যাংকে গিয়ে হাজং ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিলাম। কর্মকর্তারা বললেন, ‘ভালো করে বাংলা বলুন’!

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শেরপুরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ৮৪০। এর মধ্যে গারো, কোচ, বর্মণ, হাজং, ডালু, হুদি, মসুর, মার্মা, ম্রো, চাক, মাহালীসহ ১৬টির বেশি সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে গারোরা সবচেয়ে বেশি, এরপর রয়েছে বর্মণ, কোচ, হাজং ও হুদি সম্প্রদায়।

Advertisement

“একবার ব্যাংকে গিয়ে হাজং ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিলাম। কর্মকর্তারা বললেন, ভালো করে বাংলা বলুন”

শেরপুরের বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা বিভিন্ন রকম। নালিতাবাড়ীতে তাদের সংখ্যা ৮ হাজার ১১১, ঝিনাইগাতীতে ৬ হাজার ৯৩৮, শ্রীবরদীতে ৩ হাজার ৪৭৬, সদরে ১ হাজার ৫৩১ এবং নকলায় মাত্র ৭৮৪ জন। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ৭৩.২৭ শতাংশ পরিবার পুরুষ প্রধান এবং ২৬.৭৩ শতাংশ পরিবার নারী প্রধান।

এদিকে বেসরকারি সংস্থা আইইডির (ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তথ্য অনুযায়ী, জেলার সীমান্তবর্তী তিনটি উপজেলা শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীতে সাতটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে গারো ২৬ হাজার, বর্মণ ২২ হাজার, কোচ ৪ হাজার, হাজং ৩ হাজার, হদি ৩ হাজার ৫০০, ডালু ১ হাজার ৫০০ এবং বানাই সম্প্রদায়ের মাত্র ১৫০ জন।

বিবিএসের আরেকটি গবেষণা বলছে, শেরপুরের ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী এখনো স্কুলের বাইরে। উচ্চশিক্ষিত মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে অনেকেই ভাষার সঙ্গে নিজেদের শিকড় হারিয়ে ফেলছে।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সন্ধ্যা কোচ জানায়, স্কুলে শুধু বাংলা পড়ে সে। মাতৃভাষায় কিছু নেই। ফলে তারা তাদের ভাষা ভুলে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন-

আন্দোলনের মুখে পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে শিক্ষায় এগিয়ে হাজং

স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্লোডিয়া নকরেক কেয়া বলেন, আগে আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতাম, কিন্তু এখন বাংলা ছাড়া কিছুই নেই। স্কুল, কলেজে আমাদের ভাষার কোনো চর্চাই হয় না। শুনেছি স্কুলে আমাদের ভাষার বই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক নেই। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, আমাদের ভাষার শিক্ষক নিয়োগের জন্য।

শিউলি মারাক বলেন, আমাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতে চাই, কিন্তু সমাজ আমাদের সেই সুযোগ দেয় না।

সুকেশ বর্মণ বলেন, আমরা বর্মণ ভাষায় কথা বলতে পারি না, বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের ভাষার বই যদি সরকার চালু করতো, তাহলে আমাদের ভাষাটা টিকে থাকত।

শিক্ষকরাও মনে করেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত না হলে এই জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয়।

স্থানীয় এক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুব্রত রেমা বলেন, আমরা চেষ্টা করি মাতৃভাষার কিছু উপাদান ক্লাসে আনতে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক নেই, ফলে তা সম্ভব হয় না। যদি সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষায় বই তৈরি করত, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভাষা রক্ষা করতে পারত।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, চলতি বছর গারো ভাষার বই এসেছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। এছাড়া প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবও রয়েছে, যার কারণে মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

“আমরা বর্মণ ভাষায় কথা বলতে পারি না, বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের ভাষার বই যদি সরকার চালু করতো, তাহলে আমাদের ভাষাটা টিকে থাকত।”

আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি শুধু তাদের নিজস্ব সম্পদ নয়, এটি দেশের ঐতিহ্যের অংশ। এই ভাষাগুলো হারিয়ে গেলে আমরা আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হারিয়ে ফেলবো।

জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও সংস্কৃতি রক্ষায় কালচারাল একাডেমি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিটি ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কাজ করছি।

এফএ/এমএস