প্রবাস

বিভিন্ন দেশে ভালোবাসা দিবস উদযাপন এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা

১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় ভালোবাসা দিবস। এটি মূলত ভালোবাসা প্রকাশের দিন, যেখানে মানুষ তাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও স্নেহ প্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। তবে ভালোবাসা কি শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ? একেবারেই নয়। ভালোবাসা পরিবারের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, মানবতার প্রতি—এটি একটি বিশাল অনুভূতি, যা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে।

Advertisement

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভালোবাসা দিবসের উদযাপন

সুইডেন:সুইডেনে ভালোবাসা দিবসকে “Alla hjärtans dag” (সকল হৃদয়ের দিন) বলা হয়। সুইডিশরা এই দিনে ফুল, চকলেট এবং শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করে। পরিবার, বন্ধু ও প্রেমিক-প্রেমিকা সবাই একসঙ্গে উদযাপন করে এবং অনেকেই বিশেষ ডিনার বা ভ্রমণে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র:যুক্তরাষ্ট্রে ভালোবাসা দিবস অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদিন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী উপহার, ফুল, কার্ড এবং চকোলেট দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে। রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফেগুলো বিশেষ আয়োজন করে এবং অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দেয় এই দিনে।

ফ্রান্স:ফ্রান্সে ভালোবাসা দিবস অত্যন্ত রোমান্টিকভাবে উদযাপিত হয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে চিঠি, কবিতা ও উপহার দেয়। ফ্রান্সকে ভালোবাসার দেশ বলা হয়, তাই এখানে এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

Advertisement

জাপান:জাপানে ভালোবাসা দিবসে মেয়েরা ছেলেদের চকলেট উপহার দেয়। এক মাস পর, ১৪ মার্চ “হোয়াইট ডে” পালিত হয়, যেখানে ছেলেরা মেয়েদের উপহার দেয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত:মিডিলইস্টের দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভালোবাসা দিবস বেশ জনপ্রিয়, বিশেষ করে দুবাই ও আবুধাবির মতো বড় শহরগুলোতে। বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলো এই উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে। তবে ঐতিহ্যগতভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো রক্ষণশীল সমাজে এই উদযাপন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত থাকে এবং কেউ কেউ এটিকে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব হিসেবে দেখে।

বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের উদযাপনবাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই দিনটি উদযাপনের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তারা সাধারণত—• লাল পোশাক পরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে।• প্রিয়জনকে ফুল, চকলেট, উপহার ও কার্ড দেয়।• বিশেষভাবে সাজানো রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফেতে সময় কাটায়।• সামাজিক মাধ্যমে ভালোবাসাময় পোস্ট শেয়ার করে।• অনেকে এই দিনে বিয়ের প্রস্তাব দেয় বা বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করে।

তবে অনেকেই মনে করেন, ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন নেই। সত্যিকারের ভালোবাসা প্রতিদিনই প্রকাশ করা উচিত।

Advertisement

ভালোবাসার বহুমাত্রিকতাভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ স্নেহ, ভাই-বোনের খুনশুটি, বন্ধুত্বের নির্ভরতা এবং মানবতার জন্য আত্মত্যাগেও প্রকাশ পায়। প্রকৃতির প্রতিও ভালোবাসা থাকা উচিত, যেখানে গাছপালা, পশুপাখি ও পরিবেশের যত্ন নেওয়া ভালোবাসারই আরেকটি রূপ।

বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভালোবাসা গভীরভাবে প্রোথিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন—তাদের কবিতা ও গানে ভালোবাসার অনন্য প্রকাশ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘ভালোবাসায় জিত আছে, হার নেই,যত দেবে ততই তুমি পাবে, তার বেশি কিছু নেই।’

এই কথাগুলো প্রমাণ করে, ভালোবাসা বিনিময়ের বিষয় নয়, এটি একটি অনুভূতি, যা নিঃস্বার্থভাবে দিলেই সত্যিকার অর্থে পাওয়া যায়।

সমাজ ও ভালোবাসা দিবসের বিতর্কঅনেকেই ভালোবাসা দিবসকে শুধু পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ মনে করেন এবং এর বিরোধিতা করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে, ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা সংস্কৃতির নয়। এটি সর্বজনীন এবং মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ। ভালোবাসার প্রকাশের জন্য যদি একটি দিন মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রিয়জনদের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া দরকার, তবে সেটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক।

বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে ভালোবাসা দিবসের উদযাপনবাংলাদেশের শহর ও গ্রামের ভালোবাসা দিবস উদযাপনে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। শহরে তরুণ-তরুণীরা সাধারণত রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, পার্ক কিংবা শপিংমলে গিয়ে দিনটি উদযাপন করে। উপহার, ফুল, চকলেট বিনিময়, সামাজিক মাধ্যমে ভালোবাসাময় পোস্ট দেওয়া, বিশেষ ফটোশুট করা—এসব এখন শহুরে ভালোবাসা দিবসের চেনা দৃশ্য।

অন্যদিকে, গ্রামের মানুষের কাছে ভালোবাসার প্রকাশ একটু ভিন্ন। সেখানে এখনো পারিবারিক বন্ধন ও সরলতা বেশি। তরুণ-তরুণীরা হয়তো সরাসরি প্রকাশ করতে ইতস্তত বোধ করে, তবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে হাঁটতে যাওয়া, নদীর ধারে বসে গল্প করা কিংবা একসঙ্গে মেলা বা পহেলা ফাল্গুনের উৎসবে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে। অনেক সময় ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গ্রামের তরুণদের মধ্যে কাব্য, গান, কিংবা নাটকের আয়োজনও দেখা যায়।

যেখানে শহরে ভালোবাসা দিবসের উদযাপন হয় বাহ্যিক আয়োজনের মাধ্যমে, সেখানে গ্রামে এটি হয় অন্যরকম অনুভূতির এক মধুর প্রকাশ—যেখানে প্রকৃতি, নির্জনতা, আর আন্তরিকতাই ভালোবাসার আসল ভাষা।

ভালোবাসা প্রকাশের সহজতম উপায়ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কি সবসময় উপহার, চকলেট বা দামি সামগ্রী প্রয়োজন? একদমই না। কখনো কখনো একটি একগুচ্ছ ফুল, একটি সত্যিকারের হাসি বা একটি আন্তরিক শুভেচ্ছা-ই হয়ে উঠতে পারে হৃদয়ের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।

বসন্তের এই বাতাসে বাংলাদেশ ভরে ওঠে নানা রঙের ফুলে—কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, শিউলি কিংবা পলাশের লাল আভা। ভালোবাসার অনুভূতি ঠিক এই ফুলগুলোর মতোই—সুগন্ধি, কোমল ও স্বতঃস্ফূর্ত। দুটো মন যখন প্রকৃতির রঙে মিশে যায়, তখন ভালোবাসা শুধু কথায় নয়, মনের মাধুরী দিয়ে আঁকা স্মৃতির ক্যানভাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

ভালোবাসা তো আসলে অনুভূতির নাম, যেখানে সময়ের সঙ্গে পুরোনো হয় না কোনো স্মৃতি বরং প্রতিটি মুহূর্ত মধুময় হয়ে ওঠে ভালোবাসার সুরে। কারণ ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম