ফিচার

গ্রন্থাগার: হারানো স্বপ্নের আলোতে জ্ঞান অন্বেষণ

সুদীপ্ত শামীম

Advertisement

আজকের দিনে যখন তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, তখন গ্রন্থাগারের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের মনোভাব কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এক সময় গ্রন্থাগার ছিল মানুষের চিন্তা-ভাবনার একটি উজ্জ্বল দিকনির্দেশক, যেখানে প্রতিটি বই ছিল নতুন কিছু শেখার সুযোগ, সৃজনশীলতার জগতের এক অমূল্য রত্ন। সেখানে ছিল ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন এবং বিজ্ঞানের অজস্র দিকের বর্ণনা। কিন্তু আজ, ডিজিটাল যুগের আগমন ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসারে, গ্রন্থাগারের সেই আদিম ভূমিকা অনেকাংশেই ক্ষীণ হয়ে গেছে। এটা একটা বড় ধরনের সাংস্কৃতিক সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়, কারণ গ্রন্থাগার শুধু বইয়ের সংগ্রহস্থল নয়, এটি সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির উৎসস্থল।

গ্রন্থাগার এমন একটি জায়গা, যেখানে মানুষ শুধু বই পড়ার জন্য নয়, বরং নিজের চিন্তা ও মনোভাব গঠন করার জন্যও আসত। এখানকার পরিবেশ, বইয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর অভ্যস্ততা, এগুলো সব মিলে এক নতুন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করত। গ্রন্থাগারের কাঠামো ছিল এক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোনো একটি বিষয়ের উপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা সম্ভব ছিল। এটি শুধু ব্যক্তির জ্ঞান বৃদ্ধিতেই সহায়ক ছিল না, বরং একে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আজকের দিনে যেখানে মানুষ নিত্যদিন তথ্যের চাহিদা পূরণ করে থাকে, সেখানে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব যেন কমে যাচ্ছে, কিন্তু আসলেই কি তা কমে গেছে?

বিশ্বের সব উন্নত দেশের গ্রন্থাগারগুলো আজও নিজেদের সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এই গ্রন্থাগারগুলোতে রাখা বই শুধু পাঠককে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে না, বরং সমাজের গতিপথ নির্ধারণে সাহায্য করে। যেমন ধরুন, গ্রন্থাগারে রাখা একটি ইতিহাসের বই পাঠকের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা জাগিয়ে তুলতে পারে অথবা কোনো সমাজবিদ্যার বই সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যা সমাধানে নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আমাদের শেকড়, আমাদের অতীতের গৌরব, আমাদের সমাজের অগ্রগতি ও পতন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার সেই স্থানে পরিণত হয়েছিল, যেখানে একসময় অনেক আন্দোলন ও বিপ্লবের চিন্তা-ভাবনা জন্ম নিয়েছিল।

Advertisement

তবে বর্তমান সময়ে গ্রন্থাগারের প্রতি আগ্রহের অভাব একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে, এখন গ্রন্থাগারগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক গ্রন্থাগার আজকাল শুধু বইয়ের সংগ্রহস্থল হিসেবে চিহ্নিত হলেও, সেগুলোর কাছে তেমন কোনো পাঠক উপস্থিত থাকে না। এছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বইয়ের হালচাল অবস্থা, অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো বইয়ের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, সেগুলোর কোনো ব্যবহারিক মূল্য থাকে না। এই পরিস্থিতি অনেক জায়গাতেই গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে।

গ্রন্থাগারের এক ধরনের শাশ্বত সৌন্দর্য ছিল, যে সৌন্দর্য কোনো ডিজিটাল প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা অনলাইন মাধ্যম কখনো প্রদান করতে পারে না। বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা এক নতুন দুনিয়ার কথা, যেখানে পাঠক শুধু তথ্য পায় না, বরং এক নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়। বইয়ের প্রতি পাঠকের আসক্তি, একটি বইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং দর্শনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা, এগুলো সবই ছিল এক বিশেষ প্রক্রিয়া। অথচ আজকের ডিজিটাল যুগে, আমরা তথ্য সংগ্রহে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছি, কখনোই সেই বইয়ের গাম্ভীর্যতা অনুভব করতে পারি না। বইয়ের পৃষ্ঠায় যে গন্ধ, তার মধ্যে যে স্নিগ্ধতা ছিল, সেটি আমাদের দেহ ও মনকে স্পর্শ করে। বই পড়া ছিল এক ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যেখানে আমরা হারিয়ে যেতাম এবং পৃথিবী থেকে একে একে চলে যেতাম, এক নতুন জ্ঞানভাণ্ডারে।

এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। এই চিত্র বদলানোর জন্য আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। গ্রন্থাগারের আধুনিকীকরণ, বইয়ের সংগ্রহ বৃদ্ধি, পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি, এগুলো সবই আমাদের দায়িত্ব। ডিজিটাল গ্রন্থাগারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা কখনোই বইয়ের শারীরিক উপস্থিতির বিকল্প হতে পারে না। আজকের ডিজিটাল যুগে, আমরা বইয়ের খোঁজ করার জন্য অনেক সময় ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে থাকি, কিন্তু তা কেবল এক দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য প্রদান করে। গ্রন্থাগারের বই আমাদের একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার সুযোগ দেয়, যা আমাদের চিন্তাধারার বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করে।

গ্রন্থাগারের আধুনিকীকরণ অবশ্যই প্রয়োজন, তবে এটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করা। বই পড়া আমাদের জ্ঞানের অমুল্য রত্ন। গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়ার যে অভ্যস্ততা, সেটি আগামী প্রজন্মের মধ্যে তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী-সবার জন্য গ্রন্থাগারের সহায়ক ভূমিকা আরও বড় করা উচিত। এটিই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমে আমরা একটি সংস্কৃতিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এছাড়া গ্রন্থাগারের অবকাঠামো ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। আজকের দিনে যখন গ্রন্থাগারের ভবনগুলোও অনেক সময় জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে, তখন স্থানীয় প্রশাসন এবং সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গ্রন্থাগারের পুনর্নির্মাণ এবং আধুনিকীকরণের কাজ করা জরুরি। সৃজনশীল কার্যক্রম যেমন বই প্রদর্শনী, সাহিত্য আলোচনা, লেখক সাক্ষাৎকার আয়োজন ইত্যাদি, এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে পাঠকদের আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি ও আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব।

Advertisement

আমাদের প্রজন্মের দায়িত্ব, যেন আমরা গ্রন্থাগারের ঐতিহ্যকে আরও দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পারি। গ্রন্থাগারগুলোর উন্নয়ন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করা এবং সমাজে একটি সুস্থ পাঠক সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটানো যেতে পারে। এই কাজটি একমাত্র সমাজের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব। শুধু সরকার নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গ্রন্থাগারের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব। অতএব, আসুন আমরা সবাই মিলে গ্রন্থাগারকে আমাদের জীবনের অংশ বানাই, সেই হারানো স্বপ্নের আলোকে আমাদের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করি এবং তার অমূল্য রত্নকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করি। গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের শাশ্বত আলো, যার বিকিরণে পৃথিবীকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারি আমরা। আরও পড়ুন

সবচেয়ে দুর্গন্ধময় যেসব জিনিস স্থান পেয়েছে গিনেস রেকর্ডে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পৃথিবী আজ বিপন্নের পথে

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

কেএসকে/এমএস