• বস্তায় ৫০০ বাড়ার পর কমেছে ২০০ টাকা• করপোরেট মজুতদারিতে চালের বাজারে সংকট• পাইকারিতে কিছুটা কমলেও আঁচ পড়েনি খুচরায়
Advertisement
চট্টগ্রামে হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারেই প্রতি বস্তা (৫০ কেজি ওজনের) চালে ১৫ দিনের ব্যবধানে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর শেষ সপ্তাহে বস্তাপ্রতি কমেছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগামী বৈশাখে বোরো মৌসুমের নতুন চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম ওঠানামায় থাকতে পারে।
চাল ব্যবসায়ীদের দাবি, বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিরিক্ত মজুতদারি বাজারে সংকট তৈরি করছে। এ নিয়ে সরকারের তেমন নজরদারিও নেই। বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ তাদের।
চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানি দেলোয়ার হোসেন। কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে জানান, গত ১৫ দিনের ব্যবধানে চালের দাম অনেক বেড়েছে। রহমান কাটারি (কাটারিভোগ) এখন (বৃহস্পতিবার) বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৮৫ টাকা। মিনিকেট আতপ ছিল ৭০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকা। ৮৫ টাকার সেদ্ধ নাজিরশাইলের দাম উঠেছে ৯০ টাকায়।
Advertisement
এসময়ে জিরাশাইল সেদ্ধ চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে এ চাল ছিল প্রতি কেজি ৭৫ টাকা। এখন বিক্রি করছি ৮২ টাকায়। মিনিকেট সেদ্ধ ছিল ৬০ টাকা। এখন প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৬৫ টাকায় উঠেছে, জানান এই খুচরা ব্যবসায়ী।
আরও পড়ুন
দুই জাহাজে এলো ৩৭ হাজার টন চাল আয়-ব্যয়ে অসংগতি, দিন পার করতে নাভিশ্বাস আমিও মধ্যবিত্ত, আমিও চাপে আছি: চালের দাম নিয়ে খাদ্য উপদেষ্টাখুচরা বাজারে বাড়লেও পাইকারিতে চালের দাম কমছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিক উল্লাহ। তিনি নগরীর চাক্তাই এলাকার মেসার্স রফিক উল্লাহ রাইচ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী। এবার সরকারের অনুমতি নিয়ে চালও আমদানি করেছেন তিনি।
জিরাশাইল সেদ্ধ চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে এ চাল ছিল প্রতি কেজি ৭৫ টাকা। এখন বিক্রি করছি ৮২ টাকায়। মিনিকেট সেদ্ধ ছিল ৬০ টাকা। এখন প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৬৫ টাকায় উঠেছে, জানান এই খুচরা ব্যবসায়ী
Advertisement
কথা হলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাগো নিউজকে বলেন, আমন মৌসুমে সারাদেশে বন্যার কারণে ফলন কম হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। এখন ভারত থেকে পর্যাপ্ত চাল আমদানি হয়েছে। কয়েকদিন ধরে চাক্তাইয়ের বাজারে বিক্রি কম। দামও পড়তির দিকে। আমনের ভরা মৌসুমে বড় বড় করপোরেট ব্যবসায়ীরা বেশি করে ধানের মজুত করেছেন। এ কারণে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না।
সরেজমিনে বিভিন্ন আড়ত ও খুচরা বাজার ঘুরে জানা গেছে, গত ১৫ দিন ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিশেষত আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পর নতুন মৌসুমের ধান ওঠার মাঝের সময়টাতে বাজারে চালের সংকট তৈরি হয়। বিগত বছরগুলোতেও ওই মাঝের সময়টাতে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে দেখা গেছে। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। আমন মৌসুম শেষ হলেও চালের বাজারে ক্রেতাদের জন্য কোনো সুখবর নেই।
বলা হচ্ছে, গত আমন মৌসুমে দেশে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণে ফলনে প্রভাব পড়েছে। এতে সরকারি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। সরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়।
খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গত ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০ টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে চাল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ২৪০ টন। যেখানে সরকারিভাবে ৮৬ হাজার ৮১০ টন আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩০ টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৬৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৭০ টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছিল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭৭১ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এরমধ্যে ৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৮৭ টন চাল, ১৪ হাজার ৩৬৩ টন ধান (চালের আকারে) এবং ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯ টন গম মজুত রয়েছে।
আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পর নতুন ধান ওঠার মাঝের সময়টাতে বাজারে চালের সংকট তৈরি হয়। বিগত বছরগুলোতেও মাঝের সময়ে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে দেখা গেছে। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। আমন মৌসুম শেষ হলেও চালের বাজারে ক্রেতাদের জন্য কোনো সুখবর নেই
চাক্তাই ও পাহাড়তলীর চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৫ দিন আগে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজিতে) ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। এরমধ্যে গত দুই-একদিন ধরে আবার প্রতি বস্তায় ২০০ টাকার মতো কমতে শুরু করলেও পাইকারি আড়তগুলোতে খরিদ্দার কম।
চালের দামের এ ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষ নাভিশ্বাস তুলেছে। বিশেষত চট্টগ্রামে চালের অস্বাভাবিক দামে দুর্ভোগ বাড়ছে সীমিত আয়ের মানুষের।
চাক্তাইয়ের চালের আড়তদার ব্যবসায়ী মেসার্স সেকান্দার হোসেনের পরিচালক জাহেদুল ইসলাম শাওন জাগো নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার কাটারিভোগ আতপ ২৫ কেজির বস্তা ২১০০ টাকা, ভালো মানের ২৮-বেতি ৩৪৫০ টাকা, জিরাশাইল সেদ্ধ ৫০ কেজির বস্তা ৪ হাজার টাকা, কাটারি ৩২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে নুরজাহান সেদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ৫০ কেজি ২৭০০ টাকা।
তিনি জানান, এসব চালের ভোক্তা সাধারণত সীমিত আয়ের মানুষেরাই। এছাড়া গত ১৫ দিনে আমদানিকৃত ভারতীয় চালের দাম বস্তাপ্রতি এক থেকে দুইশো টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
তবে আমদানিকৃত ভারতীয় চালের দাম বাড়েনি বলে দাবি করেন আমদানিকারক ব্যবসায়ী মেসার্স রফিক উল্লাহ রাইচ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী রফিক উল্লাহ। তিনি বলেন, আমি নিজেও চাল আমদানি করেছি। আমদানিমূল্যের সঙ্গে বিক্রি (বিক্রয়মূল্য) মিলছে না। আমদানি করা ভারতীয় চালের দাম বাড়েনি, বরং কমে গেছে। এতে চাল আমদানি করে আমরা লোকসানের মুখে পড়ছি।
আরও পড়ুন
দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম, থামাবে কে? রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্নের আশঙ্কা সেই ‘চালবাজির চক্রেই’ চড়া চালের বাজারচট্টগ্রামে পাইকারি চালের আরেক বড় বাজার পাহাড়তলী বাজার। বাজারটির ব্যবসায়ী ও সমিতির নেতা জাফর উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০-১০০ টাকা করে কমছে। গত এক সপ্তাহ আগে চালের বাজার হু হু করে বেড়েছিল। আমদানিকৃত ভারতীয় চালের দামও বেড়েছিল। দেশি কাটারি আতপ ২৫ কেজি ২১০০ টাকা, রহমান নাজিরশাইল ২১৭৫ টাকা, ২৮-বেতি মানভেদে ২৮৫০ থেকে ৩৪৫০ টাকা ছিল।
তিনি বলেন, সরকার বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির জন্য এলসি ওপেন করে দিলেও ডলার সংকটের কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকে চাল আমদানি করতে পারছেন না। আবার বড় বড় করপোরেট গ্রুপগুলো চাল আমদানি করছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যাংকগুলো থেকে শিল্প ক্যাটাগরির ঋণ পাচ্ছে। যে ঋণের সুদহার অনেক কম। কিন্তু আমাদের মতো ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণে সুদহার বেশি। সব মিলিয়ে প্রকৃত চাল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভোক্তারাও ঠকছেন।
আগে বড় বড় চাতাল মালিকরা ধানের মজুত করতেন। সরকারি নজরদারির কারণে তারা এখন মজুত করতে পারছেন না। এখন মজুত করছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের কারণে দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের উচিত মজুত তদারকি করা।- চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম জাগো নিউজকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতির কারণে গত আমন মৌসুমে দেশে ধানের ফলন কম হয়েছে। যে কারণে খাদ্য চাহিদা মেটাতে সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানিতে সায় মেলে। এরই মধ্যে পর্যাপ্ত চাল আমদানি হয়েছে। বাজারও স্বাভাবিক রয়েছে। চলতি সপ্তাহে পাইকারি বাজারে চালের দাম কমেছে।
তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে দাম কমলে খুচরায় তার প্রভাব পড়তে সপ্তাহখানেক সময় লাগে। যে কারণে পাইকারিতে দাম কমার আঁচ এখনো লাগেনি খুচরা বাজারে। আগামী সপ্তাহে খুচরা বাজারেও চালের দাম কমবে।
‘আগে বড় বড় চাতাল মালিকরা ধানের মজুত করতেন। সরকারি নজরদারির কারণে তারা এখন মজুত করতে পারছেন না। এখন মজুত করছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের কারণে দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের উচিত এসব করপোরেট হাউজগুলোর মজুত তদারকি করা’- বলেন এ ব্যবসায়ী।
এমডিআইএইচ/এমকেআর/এমএস