মতামত

এবার পুঁজিবাজারের দিকে নজর দিন

ছাত্রজনতার আন্দোলনের পর যে পরিবর্তন এসেছে দেশে তাতে অনেকের মত আমিও আশাবাদী ছিলাম যে, এবার পুঁজিবাজারের লুটপাট বন্ধ হবে। উন্নত দেশের মত আমাদের দেশেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এবং শিল্পখাত জেগে উঠবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার হলেও পুঁজিবাজারে সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি।

Advertisement

সারা বিশ্বেই বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপন ও সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের বড় অংশ আসে পুঁজিবাজার থেকে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ইকুইটি ছাড়াও বন্ড মার্কেট থেকে অর্থ সংগ্রহে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশে হয় এর উল্টো। সহজলভ্য হওয়ায় নতুন শিল্প স্থাপন কিংবা পুরোনো শিল্প সম্প্রসারণের জন্য তহবিল সংগ্রহে ব্যাংকের মেয়াদি শিল্প ঋণকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহে দীর্ঘসূত্রতা ও কার্যকর বন্ড মার্কেটের অনুপস্থিতি উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারবিমুখ করছে। এতে অপরিণতই থাকছে দেশের পুঁজিবাজার। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে পুঁজিবাজারকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজার থেকে শিল্পে অর্থায়নের তুলনামূলক পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুঁজিবাজারের অবদান এক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে কমছে।

ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় শুধু ব্যাংক খাতের সংস্কার করাই যথেষ্ট নয়। ব্যাংকগুলোর অর্থায়ন নীতিমালাকেও বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে চলতি মূলধন ও স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন ব্যাংক খাত থেকে আসে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য উপযোগী করে পুঁজিবাজারকে গড়ে তুলতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা সহজেই এখান থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন। এক্ষেত্রে নীতি সংস্কারের পাশাপাশি সেটি যাতে বাস্তবায়ন হয় সেদিকেও সরকারের দিক থেকে দৃঢ় ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে।

Advertisement

ভালো কোম্পানি বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে কী ধরনের নীতিসহায়তা দেয়া যায় সে বিষয়ে সরকারের নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে এজন্য আইনি কাঠামো শক্ত করতে হবে। আসল কথা, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নয়তো ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম সফল করে তোলা কঠিন হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এখনই পুঁজিবাজারের দিকে নজর দিতে হবে।

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতে দুর্দশা, উচ্চ সুদহারের মতো সংকটগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা তৈরি করেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও মুনাফা কমেছে। কেউ কেউ লোকসানের মধ্যেও পড়েছে। বিদ্যমান এ চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি আরো দীর্ঘ হবে বলেই মন হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনেকেই নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা মূল্যস্ফীতিতে কারণে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমে গেছে। অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। আবার অর্থনীতির দোদুল্যমান অবস্থায় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের পরিবর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, যা পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট তৈরি করেছে। অথচ এর পরিবর্তন হওয়া দরকার।

এগুলো সবই পুঁজিবাজারে অর্থনীতির দুর্বল ব্যবস্থাজনিত সংকট। তবে এর পেছনে সুশাসন না থাকার দায়ও কম নয়। আর এসবের দায় সবচেয়ে বেশি বর্তায় বিগত সরকারের ওপর। আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে পুঁজিবাজারের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেয়া ইত্যাদি নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের শোচনীয় অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯৯৬ ও ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে যে বড় দুই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে, সে সময়ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিগত সরকার। সে সময় সরকারের উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো বিচার ও শাস্তির পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এভাবে মূলত বিগত সরকার পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।

Advertisement

সচেতন নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিল অভ্যুত্থানের মুখে সেই সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বাড়বে। মূলত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশা জাগ্রত হওয়ার প্রভাবে কয়েক দিন সূচক ও লেনদেনে ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল। তবে সেটিও বজায় রাখা যায়নি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পাঁচ মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনো খুব বেশি আশার আলোর দেখা মিলছে না পুঁজিবাজারে। বরং আগে থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে পুঁজিবাজারে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের দুর্দশার চিত্র পুরোটা সামনে আসার পর সেটিরও প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।

টানা তিন বছর ধরে যে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে দেশের পুঁজিবাজারে, তা এ বছরের শুরুতেও রয়েছে। গত তিন বছরে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২৩ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে। আর গত সপ্তাহের পাঁচদিনই পুঁজিবাজারে সূচকের দরপতন হয়েছে। এ সময়ে ১ শতাংশের বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে সূচক, কমেছে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর। বলা বাহুল্য, পুঁজিবাজারের প্রায়ই এমন অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান। আবার সুশাসনের ঘাটতি থাকায় পুঁজিবাজারও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুঁজিবাজারের প্রতি সরকারের পূর্ণাঙ্গ অগ্রাধিকার প্রয়োজন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুশাসন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো অপরিহার্য। পুঁজিবাজারের যে ক্ষত তা রাতারাতি সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে সরকারের পুঁজিবাজারকে দাঁড় করানোর প্রয়াস দৃশ্যমান হওয়া উচিত যাতে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়।

এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সময়োপযোগী পদক্ষেপ প্রয়োজন। অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ধারণা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির ঘাটতির ফলেই পুঁজিবাজারে নানাভাবে কারসাজির ঘটনা ঘটে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হচ্ছে বাজার সৃষ্টি করা।

দেশে পুঁজিবাজারের আকারের তুলনায় বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি অর্থাৎ পুঁজিবাজারের সক্ষমতা কম। আবার সক্ষমতা না বাড়ার অন্যতম কারণ এখানে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই। এখানে নতুন পণ্য আনার জন্য কাজ হয়নি। ভালো কোম্পানির সংখ্যা অপ্রতুল ও বন্ডের বাজার সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ডেরিভেটিভস এখানে এখনো আসেনি। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রেও নতুন পণ্য নেই। বাজারে পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকায় তা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো নীতিসহায়তা নেই। নীতিসহায়তার মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে বিকশিত করতে হবে।

সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারে প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা ও দর ব্যবস্থায় অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ থেকে সরে আসতে হবে। ভালো কোম্পানি বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে কী ধরনের নীতিসহায়তা দেয়া যায় সে বিষয়ে সরকারের নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে এজন্য আইনি কাঠামো শক্ত করতে হবে। আসল কথা, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নয়তো ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম সফল করে তোলা কঠিন হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এখনই পুঁজিবাজারের দিকে নজর দিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম