খাদ্য, স্বাস্থ্য, সঙ্গ, গবেষণাসহ বিভিন্ন কারণে পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরি। সেই বিবেচনায় উদ্ভব হয়েছে জ্ঞানের কয়েকটি শাখা যেমন, প্রাণী চিকিৎসাবিজ্ঞান বা ভেটেরিনারি এবং পশুপালন বা এ অ্যানিমাল হাজবেন্ড্রি। প্রাণী চিকিৎসাবিজ্ঞান বা ভেটেরিনারি সায়েন্স বর্তমানে পড়ার বিষয় হিসেবে বেশ চাহিদাসম্পন্ন একটি বিষয়। নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ থেকে পোষা প্রাণীর চিকিৎসা ও বিভিন্ন জুনোটিক রোগ থেকে মানুষকে রক্ষায় ভূমিকা রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্সের। এ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাকৃবি ভেটেরিনারি অনুষদে কেন পড়বে একজন শিক্ষার্থী?মো. বাহানুর রহমান: প্রাণী চিকিৎসাবিজ্ঞান বা ভেটেরিনারি সায়েন্স বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের একটি। বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্বপাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। এই কলেজ এবং ভেটেরিনারি সায়েন্সকে কেন্দ্র করে ১৯৬১ সালে ফ্যাকাল্টি অব ভেটেরিনারি সায়েন্স ও কৃষি অনুষদ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। পরে অন্য চারটি অনুষদ সংযুক্ত হয়। অর্থাৎ ভেটেরিনারি অনুষদ বাকৃবির একটি প্রাচীনতম অনুষদ। এই অনুষদ প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ও চিকিৎসাসহ ভেটেরিনারির সব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। শুধু বাংলাদেশ নয়, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আসে ভেটেরিনারির ডিগ্রি নিতে। যেমন মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান, ইরানসহ আফ্রিকান বিভিন্ন দেশ থেকেও আসে। ফলে যেসব শিক্ষার্থী প্রাণিসম্পদ ও প্রাণী চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য বাকৃবি একটি যুক্তিযুক্ত পছন্দ।
জাগো নিউজ: কী কী বিষয় পড়ানো হয় এ অনুষদে?মো. বাহানুর রহমান: বাকৃবির ভেটেরিনারি ডিগ্রি পাঁচ বছর মেয়াদি। বর্তমানে এ অনুষদে ২০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে পড়ালেখা করছে ৭৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। এ অনুষদের অধীনে মোট আটটি বিভাগ, এনাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগ, ফিজিওলজি বিভাগ, ফার্মাকোলজি বিভাগ, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ এবং সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগ। এগুলোর সঙ্গে আমাদের একটি ক্লিনিক রয়েছে, সেটি ভেটেরিনারি টিচিং হসপিটাল নামে পরিচিত। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রাণিস্বাস্থ্য, উৎপাদন, খাদ্যনিরাপত্তা, প্রাণিজ আমিষের সেফটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। একই সঙ্গে তারা খামারিদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এই আট বিভাগের বাইরে অন্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যও আমরা ভেটেরিনারি সায়েন্সের বিভিন্ন কোর্স অফার করি। যেমন পোলট্রি সায়েন্স, ডেইরি সায়েন্স, এনিমেল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস্, নিউট্রেশন, এগ্রোনমি, এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, ফার্ম স্ট্রাকচার, এগ্রি ইকোনমিক্স, লাইফস্টক ইকোনমিক্স ও বায়ো স্ট্যাটিসটিক্স। কম্পিউটার সায়েন্স ও ইংরেজি ভাষার কোর্সও পড়ানো হয় আমাদের শিক্ষার্থীদের, যেন তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পারে। এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন এডুকেশনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বায়োকেমিস্ট্রিসহ এটিও ভেটেরিনারির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়।
আরও পড়ুন:বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয় নির্ধারণ করবেন কীভাবেকৃষিবিজ্ঞানে অনার্স, চাকরি কোথায়কী আশায় পড়বো আইন?জাগো নিউজ: এই বিভাগ থেকে পাস করে একজন গ্র্যাজুয়েটের কর্মজীবন কেমন হতে পারে?মো. বাহানুর রহমান: ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েটরা বিসিএস স্পেশাল ক্যাডারসহ (ভেটেরিনারি সার্জন) অন্য ক্যাডারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে। একজন ভেটেরিনারি সার্জন একটি উপজেলায় প্রাণিসম্পদের সব কার্যক্রমের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তাকে যেমন একজন ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কাজ করতে হয়, একইসঙ্গে খামারিদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও দিতে হয়। বাকৃবি থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ডিগ্রি অর্জন করে একজন শিক্ষার্থী ভেটেরিনারি সার্জন হন। এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে পাঁচ বছর পর একজন শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ একজন ভেটেরিনারিয়ানে পরিণত হন। এখানে ৯ সেমিস্টারে তাত্ত্বিক কোর্সগুলো পড়ানো হয়, আর এক সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নি করে। শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ফার্ম, ক্লিনিক, ভেটেরিনারি হাসপাতালসহ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এলআরআই), ডেভেলপমেন্ট রিসার্স ইনিশিয়েটিভ (ডিআরআই), প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস), বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালের (সিভিএইচ) মতো প্রতিষ্ঠানে হাতে-কলমে প্রয়োগিক শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষার্থীরা যে প্রয়োগিক জ্ঞান এখানে অর্জন করে, তা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তারা সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে। পাশাপাশি সেসব প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: এই সেক্টরে চাকরির বাজার খুব ভালো!মো. বাহানুর রহমান: এই অনুষদ থেকে যারা পাস করে বের হয় তাদের জন্য দেশেই চাকরির অনেক সুযোগ আছে। যেমন, সরাসরি ডিএলএসে তাদের এন্ট্রি পোস্ট ভেটেরিনারি সার্জন, সায়েন্টিফিক অফিসার, পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসারসহ থিরিওজেনলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট ইত্যাদি। ডেইরি ও পোলট্রির মতো বিভিন্ন ফার্মে কাজ করার সুযোগ আছে। এনিমাল ব্রিডিং ও জেনেটিক্স বিষয়ক কাজ করার সুযোগ আছে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিডিয়া যেমন ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও), এনিমেল প্লানেট, ডিসকভারি, ন্যাশনল জিওগ্রাফিতে চাকরির সুযোগ রয়েছে। উদ্যোক্তা হিসেবে একজন ভেটেরিনারিয়ানের পোষা প্রাণীর হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ফার্ম ব্যবসা ও ল্যাবরেটরি ভ্যাকসিনে কাজ করার সুযোগও রয়েছে। এর বাইরেও ভেটেরিনারিয়ানরা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোতে কাজ করেন। এয়ারপোর্ট ও অন্যান্য সব এলাকায় পশু ট্রান্সপোর্ট বিষয়ক বাধানিষেধ আছে, সেখানেও ভেটেরিনারিয়ানরা কাজ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কোর, যার নাম রিমাউন্ট ভেটেরিনারি অ্যান্ড ফার্ম কোর (আরভি অ্যান্ড এফসি) যেখানে একজন ভেটেরিনারিয়ান নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দিতে পারবেন। একই সঙ্গে, বিদেশ থেকে যে শিক্ষার্থীরা ভেটেরিনারি ডিগ্রি নিতে আসে, তারা পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাণিসম্পদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে। মোটকথা ভেটেরিনারিয়ানদের চাকরির অভাব হয় না।
জাগো নিউজ: মানুষের চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের কি কোনো যোগ আছে?মো. বাহানুর রহমান: হিউম্যান ডক্টরদের সঙ্গেও ভেটেরিনারিয়ানরা কাজ করছে। যেন শুধু নিরাপদই নয়, মানুষকে সুষম ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। মানুষের যেসব সংক্রামক রোগব্যাধি হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ আসে পশুপাখি থেকে। যদি আমরা নিরোগ পশুপাখি উৎপাদন করতে পারি, তাহলে একদিকে আমাদের আমিষের উৎপাদন বেড়ে যাবে ও ডিম-দুধের চাহিদা পূরণ হবে। একইসঙ্গে জুনোটিক রোগ, যা পশুপাখি থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায় ও প্রায়ই আমাদের বিরাট বিপদের কারণ হয়ে থাকে, যেমন করোনাভাইরাস, নিপা ভাইরাস, র্যাবিস, অ্যানথ্রাক্স, এ ধরনের রোগ থেকে আমরা মানুষকে রক্ষা করতে পারবো। পশুর জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ভেটেরিনারিয়ানরা। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে যদি কোনো পশুর খাদ্য রপ্তানি করা হয়, সেগুলোও চিফ ভেটেরিনারি অফিসার দ্বারা সার্টিফাইড হতে হবে। এই সার্টিফিকেট ছাড়া কোনোভাবেই সেসব বিদেশে পাঠানো যাবে না। এই রেগুলেটরি দায়িত্ব পালন করেন ভেটেরিনারিয়ানরা।
জাগো নিউজ: এই বিষয়ে গবেষণার গুরুত্ব কতটা?মো. বাহানুর রহমান: ভেটেরিনারি অনুষদের আট বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এসব ডিগ্রি মূলত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়, এবং শিক্ষার্থীরা এখানে উচ্চমানের গবেষণা করে তাদের থিসিস সমাপ্ত করে। মাস্টার্স ডিগ্রি দেড় বছর মেয়াদি এবং পিএইচডি শেষ করতে ন্যূনতম তিন বছর লাগে। এসব উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদ একটি অগ্রগামী শিক্ষাক্ষেত্র।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভেটেরিনারি সেবায় কী ঘাটতি আছে?মো. বাহানুর রহমান: এটি একটি অফিসিয়াল সার্ভিস। এবং আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখন গবাদিপশু, পোলট্রি ও ডিম উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধের কিছুটা ঘাটতি আছে, তবে আমরা আশা করছি, সবগুলো পুষ্টির চাহিদা মেটাতেই চেষ্টা করছে আমাদের ভেটেরিনারিয়ানরা এবং তারা নিশ্চয় সফল হবে। একজন দক্ষ ভেটেরিনারি চিকিৎসক পারেন দেশের প্রাণিসম্পদ এবং মানুষের মধ্যে মেলবন্ধ সৃষ্টি করে সমৃদ্ধশালী জাতি ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে।
Advertisement
এএমপি/আরএমডি/জেআইএম