মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) শিল্প পার্কের অনেক ফার্নিচার হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক ভবনের দরজায় ঘুন ধরেছে, দেওয়ালে দেওয়ালে পড়েছে শ্যাওলা। ভবনের ছাদেও অনেক পানি জমে আছে। প্রকল্পের আওতায় অভ্যন্তরীণ কোনো নিরীক্ষা করা হয়নি। ফলে প্রকল্প ব্যয়ের নয়-ছয় হলেও ধরার কোনো পথ নেই।
Advertisement
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরিচালিত ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) শিল্প পার্ক (তৃতীয় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
সমাপ্তি মূল্যায়নে প্রকল্পে নানান ধরনের অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
একাধিক পিডি নিয়োগ, বেড়েছে মেয়াদ ও খরচমুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাউসিয়া এলাকায় ‘এপিআই শিল্প পার্ক’ স্থাপনে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৮ সালে।১৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পূর্ণ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এর পরে ব্যয় বেড়ে ৩০১ কোটি টাকা ধরা হয়। কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ২০১৮ সালে এটির উদ্বোধন করা হয়। চার দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২৮৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খরচ করে ২০২১ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ মেয়াদে এবিএম মুসফিকুর রহমান, ২০১১ থেকে ২০১২ মেয়াদে হারুনুর রশিদ ভূইয়া, ২০১২ থেকে ২০১৮ মেয়াদে মো. আব্দুল বাছেত এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ মেয়াদে সৈয়দ শহীদুল ইসলাম প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করেন।
Advertisement
আরও পড়ুন
‘এপিআই শিল্প পার্ক ওষুধ শিল্পে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে’ সপ্তম মেয়াদেও হলো না শেষ, কাজ বাকি রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা ওষুধ টানছে না বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৪২ প্লটে ৩৫টি হাইড্রেন্ট স্থাপনওষুধ শিল্পের কাঁচামাল তৈরির শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও উদ্ভিদজাত পণ্যসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। এসব পণ্যসামগ্রীর অধিকাংশই দাহ্যশীল এবং অগ্নিকাণ্ডের স্পর্শে এসে শুধু প্রজ্বলিত হয় না, আগুনের তাপে বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গমন করে। অনেক ধরনের রাসায়নিক সামগ্রী আছে, যা আগুনে প্রজ্বলিত না হলেও আগুনের তাপে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে, যা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ লক্ষ্যে অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরামর্শ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি শিল্প প্লটের সম্মুখভাগে কমপক্ষে দুটি হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা জরুরি। অথচ ৪২টি শিল্প প্লটের জন্য ৩৫টি হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি আইএমইডির।
যেসব অনিয়ম পেয়েছে আইএমডিআইএমইডি জানায়, প্রকল্পের আওতায় ১১ লাখ ৫১ হাজার টাকা ব্যয়ে কেনা অফিস সরঞ্জামাদি ও ১৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা ব্যয়ে কেনা আসবাবপত্র সঠিকভাবে মার্কিং করে ব্যবহার করা হচ্ছে না। এতে ফার্নিচার হারিয়ে যাওয়া এবং মার্কিং না থাকায় যথাযথ স্থানে ব্যবহৃত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেনা ফার্নিচারগুলোর যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইনভেনটরি মার্কিং করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ কেনা ফার্নিচারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় এক হাজার ৫৭৫ বর্গমিটার প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের জন্য পাঁচ কোটি তিন লাখ টাকার বিপরীতে চার কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। ভবন নির্মাণকালে নকশা অনুযায়ী ৫৫ ফুট গভীরতা বিশিষ্ট ৯০টি পাইল ব্যবহার করা হয়।
Advertisement
আরও পড়ুন
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানতে গিয়ে যেন শিল্পের ক্ষতি না হয় পরিবেশবান্ধব হবে রেলপথ, চাপ কমবে সড়কে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য দুটি সুখবর-দুটি অনিশ্চয়তাআইএমইডির পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলার দরজার চৌকাঠের একটি অংশ ঘুনে ধরেছে, দেওয়ালে শ্যাওলা ধরেছে, ছাদে পানি জমে আছে এবং ছাদে ঘুণ্টি ব্যবহার করা হয়নি।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয়নিপ্রকল্পটি সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত। সরকারের অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করা জরুরি। বাস্তবায়িত প্রকল্পের আওতায় ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাহ্যিক নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। ওই অর্থবছরগুলোতে নিরীক্ষা আপত্তি দেওয়া হয়। বাস্তবায়িত প্রকল্পের আওতায় কোনো অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা এখনো সম্পন্ন করা হয়নি।
উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাগত সেবা করায় অনিয়মিত ব্যয় হয় এক কোটি ৮৮ হাজার ২২৫ টাকা। সারফেস ড্রেন, ক্রস ড্রেন/কালভার্ট নির্মাণে বিলম্বজনিত কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। চূড়ান্ত বিল দিতে তারল্য ক্ষতি বাবদ রাজস্ব ক্ষতি ৪৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩৫৬ টাকা। আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন খাতের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। ১৬ কোটি ৭৫ লাখ সাত হাজার ১৭৭ টাকা প্রভিসন করে রাখা হয়। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের জন্য দেড় ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের কথা। পরিদর্শনের সময় এমন চিত্র দেখেনি আইএমইডি।
প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা ঠিক করে সঠিকভাবে বাস্তবায়নে বিসিক বরাবর চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে আইএমইডি। আইএমইডির অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ফার্ম নিয়োগ করেই এপিআই শিল্প পার্ক প্রকল্পের প্রতিবেদন করেছি। ফার্মের কর্তাদের স্পষ্টভাবে বলেছি কোনো ধরনের পক্ষপাত করা যাবে না, সঠিক তথ্য তুলে আনতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় এপিআই শিল্প পার্কের সঠিক তথ্য পেয়েছি। প্রকল্পের যে অব্যবস্থাপনা আছে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। বিসিককে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে তারা যেন এপিআই শিল্প পার্কের সব ব্যত্যয় সংশোধন করে।’
আরও পড়ুন
গ্যাস-চুনাপাথরের অভাবে চালু হচ্ছে না কারখানা, ধরছে জং বিমানবন্দরগুলোতে লুটপাট, অনুসন্ধানে দুদক আইডিআরএর ‘লুটের প্রকল্প’, বন্ধে নেই উদ্যোগপ্রকল্প এলাকায় অব্যবস্থাপনা ও আইএমইডির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বিসিক চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দীন আহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইএমইডি প্রতিবেদন হাতে পেলে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প নিয়ে নিজেরা কোনো মূল্যায়ন করতে পারি না। আইএমইডির সমাপ্তি মূল্যায়ন হাতে পেলে সব বা কোনো অব্যবস্থাপনা থাকলে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। তবে আমরা নিজেরা একটা মধ্যমেয়াদি প্রতিবেদন করেছি।’
বিসিক চেয়ারম্যান আরও বলেন, অনেক ওষুধ কোম্পানি শিল্প পার্কে কাজ শুরু করেছে।
আইএমইডি জানায়, এপিআই শিল্প পার্ক প্রকল্পের জন্য গজারিয়ার বাউসিয়া এলাকায় ২০০ দশমিক ১৬ একর জমি ৬৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে অধিগ্রহণ করা হয়। মামলাজনিত কারণে জেলা প্রশাসন থেকে দুই দশমিক ৪৪ একর জমি সর্বশেষ ২০১৩ সালে বিসিককে হস্তান্তর করা হয়। প্রকল্প এলাকার ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৫১২ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নের জন্য ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূমি উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। কাজটি বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প এলাকাকে ১২টি লটে বিভক্ত করে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পের চারপাশে পাঁচ হাজার দুই রানিং মিটার বাইন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য আরডিপিপির সংস্থান ১৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কাজটি বাস্তবায়নের জন্য চারটি লটে বিভক্ত করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
আইএমইডির পরিদর্শনে দেখা যায়, আরসিসি পিলার, গ্রেড বিম ও টাই বিমসহ বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ৪২টি কাঁচামাল উৎপাদনকারী ওষুধ শিল্পের জন্য সব ধরনের অবকাঠামো যেমন: উন্নত প্লট, মাটি ভরাট, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ড্রেনের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন লাইন, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, পানি সরবরাহের প্রধান ও সাব-লাইন নির্মাণের মাধ্যমে শিল্প পার্ক স্থাপনের সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে।
বিসিক জানায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ১৮ কোটি ডলার বা দুই হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদার ৯৭ শতাংশই জোগান দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদন থেকে। ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে মোট ২১৩টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের ওষুধ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্টসের (এপিআই) সামান্যই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারে। প্রায় ৮৫ শতাংশ এপিআই আমদানি করতে হয়। এ বাবদ বছরে ব্যয় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। আমদানি অনুমতির জটিলতা এবং বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনার প্রক্রিয়ায়ও একটা লম্বা সময় লেগে যায়, যা হিসাবে নিলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ব্যয় মোটামুটি বড় অঙ্কের।
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের দেশীয় ওষুধশিল্পের প্রসার, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, ওষুধের মানোন্নয়নে গবেষণা এবং সর্বোপরি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেন বাংলাদেশেই উৎপাদন করা যায়– সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় এই শিল্প পার্ক চালু করা হয়। এরই মধ্যে প্রকল্পের মোট ৪২টি প্লট ২৭টি কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক্মি ল্যাবরেটরিজ, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনিহেলথ ইউনিমেড ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ এ পার্কে কারখানা স্থাপন করেছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের এপিআইর চাহিদার অন্তত ৫০ শতাংশ স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো যাবে, যদি আরও বড় কোম্পানি শিল্পে বিনিয়োগ করে। তবে গ্যাসের অপর্যাপ্ততায় এপিআই পার্কে বিনিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে।
এমওএস/এমএমএআর/এমএস